প্রকাশিত: ২৫/০৮/২০১৮ ৭:০৫ এএম

ডেস্ক রিপোর্ট
বাংলাদেশ- ২৫ আগস্ট ২০১৮: প্রায় ৭০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মিয়ানমার থেকে পালাতে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে আসার এক বছর পার হওয়ার পর; তাদের আইনী মর্যাদা (লিগ্যাল স্ট্যাটাস) প্রদানে অস্বীকৃতি, অপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তৈরি ক্যাম্পগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন ইত্যাদির কারণে এখনও তাদের জীবন ভোগান্তি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বেড়াজালে আটকে রয়েছে।

২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর পরিচালিত ‘শুদ্ধি অভিযান’ (ক্লিয়ারেন্স অপারেশন)- এর কারণে যে ভয়াবহতা ও ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হয় তা প্রায় ৭০৬,০০০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করে। এই শরণার্থীরা, পূর্ববর্তী সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ২০০,০০০ শরণার্থীদের সাথে যুক্ত হয়, যার ফলে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ৯১৯,০০০ ছাড়িয়ে যায়। এই ১২ মাসে এমএসএফ তাদের ১৯টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে বা মোবাইল ক্লিনিকে ৬৫৬,২০০-এরও বেশী মানুষকে চিকিৎসা প্রদান করেছে, যা মোট রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী।

প্রাথমিকভাবে এমএসএফ-এ অর্ধেকের বেশী রোগী সহিংসতাজনিত আঘাতের চিকিৎসা নিলেও পরবর্তীতে খুব দ্রুত ক্যাম্পের ঘনবসতি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে সৃষ্ট অসুখ নিয়ে রোগী আসতে শুরু করে।

“এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না যে এখনো ক্যাম্পের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি হচ্ছে পাতলা পায়খানা” বাংলাদেশে এমএসএফ-এর হেড অফ মিশন পাভলো কলোভস বলেন। “মানুষের একদম মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের জন্য যে অবকাঠামোর প্রয়োজন তাও এখানে এখনও অনুপস্থিত এবং এর ফলে মানুষের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ব্যহত হচ্ছে।”

শরণার্থীদের জন্য অসামান্য উদার মানসিকতার পরিচয় দিয়ে সীমানা খুলে দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ১২ মাস পরেও রোহিঙ্গাদের ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। তারা শরণার্থী হওয়া সত্ত্বেও এবং মিয়ানমার দ্বারা বিতাড়িত হয়ে দেশহীন হয়ে পড়ার পরেও এই অঞ্চলের দেশগুলো তাদের কোন রকম প্রাতিষ্ঠানিক আইনি মর্যাদা প্রদানে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।

“আমরা এমন এক অবস্থার মধ্যে আছি যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঠিক এই নামে চিহ্নিত করাও কঠিন” কলোভস বলেন। “শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গাদের যে আইনি অধিকার আছে তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানো, অথবা তাদের কোন আইনি মর্যাদা না দেয়ার মাধ্যমে এই ইস্যুতে কাজ করে যাওয়া বিভিন্ন দেশ ও অন্যান্য সংস্থা রোহিঙ্গাদের খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে রেখেছে।”

রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন, যা তাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণ, বন্ধের জন্য মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে না পারার মাধ্যমে দাতা সংস্থাগুলো ও অন্যান্য সরকার তাদের প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।

এর পাশাপাশি, বাংলাদেশে জাতিসংঘের অধীনে চলমান মানবিক কার্যক্রমের প্রয়োজনীয় অর্থের মাত্র ৩১.৭% এখন পর্যন্ত নিশ্চিত। এর মধ্যে স্বাস্থ্যখাতের বাজেটের মাত্র ১৬.৯% নিশ্চিত করা গেছে। সুতরাং অতিপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবার অনেক বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা অনেক আগে থেকেই মিয়ানমারে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত, যার মানে তারা খুবই কম টিকা কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাই প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে কলেরা ও হামের মহামারী রোধে এবং ডিপথেরিয়ার বিস্তার থামানোর ক্ষেত্রে এমএসএফ-এর পৃষ্ঠপোষকতায় গৃহীত টিকাদান কর্মসূচী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে।

রোহিঙ্গারা দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত চলে যাবে, এরকম ধারণা থেকে দীর্ঘমেয়দি ও উল্ল্যেখযোগ্য ত্রানের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ফলে অনেক মানবিক সাহায্য বাধাপ্রাপ্ত হয়। অপরিকল্পিতভাবে তৈরি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অস্থায়ী ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা যেভাবে জীবনযাপন করছে তা আন্তর্জাতিক মানবিক মানের অনেক নিচে। শরণার্থীরা এখনও প্লাস্টিক ও বাঁশ দিয়ে তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে থাকছে যেখানে তাদের প্রাথমিকভাবে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

“একটি সাইক্লোন ও মৌসুমি বৃষ্টি প্রবন এলাকায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষার জন্য কোন শক্ত অবকাঠামো নেই, এটি তাদের নিরাপত্তা ও আত্মসম্মানের উপরও বড় প্রভাব ফেলে।” কলোভস বলেন।

এমএসএফ-কে একজন শরণার্থী জানায় কত নাজুক অবস্থায় সে তার পরিবার নিয়ে ক্যাম্পে রয়েছে, “বৃষ্টির সময় আমরা সবাই একসাথে জড়ো হয় বসি, (বাসা শক্ত করে ধরে রেখে) যেন বাসা উড়ে না যায়। রাতে অনেক অন্ধকার থাকে এখানে, আমাদের কোন আলোর ব্যবস্থা নেই।”

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যে পরিমান সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছে এবং এর ফলে যে মানসিক আঘাত তারা পেয়েছে, সে তুলনায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং যৌন সহিংসতার আঘাতের চিকিৎসা সেবা অপ্রতুল। এই অবস্থা আরও জটিল হয়ছে তাদের কোন আইনি মর্যাদা (লিগ্যাল স্ট্যাটাস) না থাকার কারণে, যার ফলে তারা কোন বিচার ব্যবস্থার শরণাপন্ন হতে পারে না এবং তাদের জন্য কোন আইনও নেই। তার উপর রোহিঙ্গারা অনিচ্ছাসত্ত্বেও ক্যাম্পের ভিতরে থাকতে বাধ্য হয়, যেখানে বেশিরভাগ শরণার্থীদের যথাযথ পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা / ল্যাট্রিন, শিক্ষা ব্যবস্থা, জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই।

“এই নিষেধাজ্ঞাগুলো শুধু ত্রাণ এর পরিমান ও মাত্রাকে সীমিত করে না, সেই সাথে রোহিঙ্গাদের শুধুমাত্র মানবিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে বাধ্য করে। এটি তাদের নিজেদের জন্য একটি মানসম্মত ভবিষ্যৎ তৈরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে এবং তাদের প্রত্যেকদিনকে বেঁচে থাকার সংগ্রামে পরিনত করে।” কলোভস বলেন।

এমএসএফ যাদের সাথে কথা বলেছে, তাদের অনেকেই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।

আবু আহমাদ নামে আট সন্তানের জনক এক রোহিঙ্গা বলেন, “আমার শক্তি ও আমার কাজ করার সামর্থ্য শেষ। আমার সবসময় দুশ্চিন্তা হয়, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়। আমি খাবার, কাপড়, শান্তি আর আমাদের কষ্ট নিয়ে চিন্তা করি… আমার যদি আরও দশ বছর এখানে থাকতে হয়… অথবা এক মাস, আমাকে এই কষ্ট ভোগ করতেই হবে।”

এই দীর্ঘায়িত শরণার্থী সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান বের করা প্রয়োজন। “বাস্তবতা হচ্ছে, দশকের পর দশক ধরে এই রোহিঙ্গারা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে ও অন্যত্র অবস্থান করছে, এবং যদি কখনও সম্ভব হয়ও, তাদের মিয়ানমার ফেরত যেতে আরও অনেক বছর সময় লাগবে। রোহিঙ্গাদের এই দুর্ভোগের পরিমান ও মাত্রা স্থানীয়, আঞ্চলিক, ও বৈশ্বিকভাবে একটি বড় প্রতিক্রিয়ার দাবি রাখে।” কলোভস বলেন। “রোহিঙ্গাদের উপর যে নিপীড়ন চলছে তা বন্ধের জন্য মিয়ানমার সরকারে উপর চাপ প্রয়োগ অব্যহত রাখতে হবে।”

পাঠকের মতামত