উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬/০৪/২০২৫ ৮:২৯ এএম

বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইনে সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন-সম্প্রতি এমন একটি প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক এক গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে। সেখানে দাবি করা হয়েছে, ‘কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জান্তা সরকার এবং বিদ্রোহী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিকল্পনা করছেন। লক্ষ্য আরাকানের স্বাধীনতা।’

Advertisement

প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেমন উদ্বেগ ছড়িয়েছে, তেমনই কূটনৈতিক অঙ্গনেও দেখা দিয়েছে আলোড়ন। তবে রোহিঙ্গা নেতারা ওই খবরকে ‘ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের ভাষ্য, রোহিঙ্গারা এখন আর অস্ত্র নয়, চায় নিরাপদ প্রত্যাবাসন, সম্মানজনক নাগরিক অধিকার এবং একটি টেকসই সমাধান।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংগঠিতভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার কোনো বাস্তব সুযোগ নেই। আসলে এ ধরনের গুজবের পেছনে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে।’ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নজর রাখা গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও ওই খবরকে ‘পরিকল্পিত গুজব’ হিসাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি পরিকল্পিত গুজব : এ ধরনের খবরকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতা এবং আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের। তিনি বলেছেন, ‘ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা মানবিক সংকটে রয়েছেন। তারা অস্ত্র ধরতে নয়, মর্যাদা নিয়ে নিজভূমে ফিরে যেতে চান। কেউ কেউ বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি বা সন্ত্রাসী প্রমাণের চেষ্টা করছে, অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের একটাই চাওয়া-নিরাপদ প্রত্যাবাসন এবং নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি।’

জোবায়ের বলেন, ‘রোহিঙ্গারা কখনো বার্মা (মিয়ানমার) থেকে আলাদা হতে চান না। রোহিঙ্গারা শুধু চান পূর্ণ নাগরিক অধিকার। জন্মসনদ, চলাফেরা, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। এই অধিকার ছাড়া কোনো প্রত্যাবাসন টেকসই হবে না।’

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক লিডার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তার ওপর রোহিঙ্গা জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। আমরা চাই তিনি আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে কার্যকরভাবে কাজ করবেন। তিনি পারবেন; পারার মতো লোক।’

ডা. জোবায়ের অভিযোগ করেন, ‘সম্প্রতি একটি চিহ্নিত মহল ক্যাম্পে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে, সহিংসতা উসকে দিয়ে এবং ভুয়া খবর প্রচার করে বাংলাদেশ সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে বিপদে ফেলতে চাইছে। এসব অপচেষ্টা ক্যাম্পের নিরাপত্তা ও মানবিক পরিবেশকে বিপন্ন করতে পারে। আমরা এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাই।’ একই ধরনের কথা বলেছেন আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এমন কোনো সুযোগ বা পরিবেশ নেই : এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে এ ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ হচ্ছে না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারি। কেউ যদি বিচ্ছিন্নভাবে একটি-দুটি দেশি বন্দুক বা সেমি-অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে নাড়াচাড়া করে, সেটা বড়জোর নিজেদের জাহির করার চেষ্টা, কিংবা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারের কৌশল হতে পারে। এর সঙ্গে সংগঠিত সামরিক প্রশিক্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই।

তিনি আরও বলেন, সামরিক প্রশিক্ষণ মানে গেরিলাযুদ্ধের কৌশল, আক্রমণ প্রতিহত করা, ঘাঁটি তৈরি এবং সমন্বিত হামলা চালানোর সক্ষমতা। এ ধরনের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন নেতৃত্ব, প্রশিক্ষক, সংগঠন ও কাঠামো। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এমন কোনো সুযোগ বা পরিবেশ নেই। বাস্তবতা হলো, এ ধরনের কাজ রোহিঙ্গাদের দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ, তাদের মধ্যে সেরকম কোনো নেতৃত্বই গড়ে ওঠেনি।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর যখন মিয়ানমার স্বাধীন হয়, তখন রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। কারণ ব্রিটিশরা ওয়াদা করেছিল তারা চলে গেলে রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতা দেবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ব্রিটিশরা রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতা না দিয়ে বার্মিজদের হাতে দেশ ছেড়ে দেয়। অথচ সেই সময় জাপানি বাহিনী ও রাখাইনদের হাতে এক লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নিহত হয়।’

তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশদের সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে, সে সময় কিছু রোহিঙ্গা স্বল্প সময়ের জন্য টুকটাক অস্ত্র হাতে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যখন মিয়ানমারের তৎকালীন সেনাপ্রধান পূর্ণ নাগরিকত্ব এবং মিলেমিশে দেশ গড়ার আশ্বাস দেন, তখন রোহিঙ্গারা অস্ত্রসমর্পণ করেন। কিন্তু পরে দেখা যায় সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। বরং উলটোভাবে ভোটাধিকারসহ সব ধরনের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গারা আর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। তারা একরকম নিপীড়িত, নিঃস্ব এবং ভয়ভীতিতে ভোগা জনগোষ্ঠী হয়ে ‘গুহামানব’র মতো জীবনযাপন করে আসছেন। এরপরও টিকতে না পেরে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার সংগঠিতভাবে যুদ্ধ করবে এটা বিশ্বাস করার মতো কিছু নয়।’

পরিকল্পিত ভারতীয় প্রোপাগান্ডা-শরণার্থী কমিশনার : রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের প্রস্তুতিসংক্রান্ত সাম্প্রতিক অভিযোগকে ‘টোটাল পরিকল্পিত এবং ভারতের প্রোপাগান্ডা’ বলে অভিহিত করেছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) এবং অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এর মাধ্যমে তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইছে।’

মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা এখন বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত বিষয়টি ভালোভাবেই জানে এবং চায় এই সমস্যা আরও জটিল হোক। তারা চায়, রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটুক।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘সম্প্রতি ব্রিটিশ একটি গণমাধ্যমের রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে বাংলাদেশে কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল গুজবভিত্তিক সংবাদ প্রকাশ করেছে। আমি অনেকের কাছে ওই ব্রিটিশ গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদের লিংক চেয়েছি, কিন্তু কেউ তা দেখাতে পারেনি। আসলে দেশটা আমাদের সবার। তাই দেশের স্বার্থে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করা উচিত।’

এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ক্যাম্পে নিরাপত্তায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। সুত্র: যুগাস্তর

পাঠকের মতামত

দৈনিক জনকণ্ঠের রিপোর্ট রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর সরকারি লাইসেন্স নেই, তদন্ত টিমের পরিদর্শন

রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা উখিয়ায় ১৫টি ক্লিনিক হাসপাতাল ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার চলছে অনুমতি বিহীন। সরকারিভাবে কোন ...

উখিয়ায় র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণ, ইউনিফর্ম, অস্ত্র-গুলি ও হাতকড়াসহ আটক ১

কক্সবাজারের উখিয়ায় র‌্যাব পরিচয়ে রোহিঙ্গা যুবককে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা এবং প্রতারণার অভিযোগে একটি সংঘবদ্ধ ...