
উখিয়া নিউজ ডটকম::
বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে ভিটেমাটি নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে মিয়ানমার সামরিক জান্তা। সেখানে গিয়ে থাকতে হবে, তাদের তৈরি করা ক্যাম্পে। তাও আবার ক্যাম্প থেকে বেরুনো যাবে না। মিয়ানমার জান্তা কর্তৃক তৈরি করা তালিকামতে রোহিঙ্গাদের গ্রেফতারের আশংকা আছে। অনেকটা গৃহবন্দি অবস্থায় প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের দিন যাপন করতে হবে। বহুমাত্রিক অভাব, আতংক, গরিবি হালতে বন্দিদশা মাথায় নিয়ে রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে। খুবই হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় কথাগুলো বললেন বুচিডং জেলার কোয়াইচং পাড়া গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক আমান উল্লাহ (৪৫)।
তিনি সাংবাদিকদের জানান, বুচিডং জেলার বৃহত্তর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি অধ্যুষিত কোয়াইচং গ্রামের অধিকাংশ পরিবার বৃত্তশালী। গ্রামের মাতবর, সর্দার ও হুক্কট্টাদের (চেয়ারম্যান) সাথে রাখাইন সরকারি কর্মকর্তাদের ছিল সহনীয় মনোভাব। যে কারণে মিয়ানমার সেনা, বিজিপি ও উগ্রপন্থী রাখাইন জনগোষ্ঠি ইতিপুর্বে কোয়াইচং গ্রামে কোনো প্রকার অসদাচরণ বা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেনি। এক কথায় বলতে গেলে, কোয়াইচং গ্রামের মানুষ খুব সুখেই দিন যাপন করছিল।
চলতি বছরের ২ ডিসেম্বর রাখাইন থেকে চলে এসে আশ্রয় নেওয়া কোয়াইচং গ্রামের হুক্কট্টা এনায়েত উল্লাহ (৫৫) জানান, ওই রাতে সেনাক্যাম্প থেকে ফোন করে জানানো হয়, বুচিডংয়ের পুরাতন সেনা ডিভিশন বদলি হয়ে চলে যাচ্ছে। নতুন যারা আসবে তারা তোমাদের সাথে পরিচিত নয়। সেহেতু তারা তোমাদের ক্ষতি করতে পারে। তাই তোমরা রাতের মধ্যে অন্যত্র চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। এর কিছুক্ষণ পরে ২ রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ হয় হুক্কট্টার বাড়িতে। এ ঘটনায় পুরো কোয়াইচং গ্রামে হৈচৈ পড়ে যায়। যে-যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় বাড়িঘর ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে শুরু করে। হুক্কট্টা জানান, তার বাড়িটি দ্বিতল, গাছের তৈরি কারুকাজসম্পন্ন রুচিশীল বসতবাড়ি। তার বাড়িতে অনেক সময় মিয়ানমার সেনা-বিজিপি সদস্যরা খাওয়া-দাওয়া করেছে। হঠাৎ করে এমন পরিবর্তন কোনোদিন আশা করিনি। জানলে আগে থেকেই মালামাল, টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার এদেশে পাঠিয়ে দিতাম।
মঙ্গলবার উখিয়ার মধূরছড়া ক্যাম্পে তার সাথে আলাপ করার সময় তিনি কেঁদে-কেঁদে বলেন, আমার বাড়িতে দৈনিক ১৮/২০ শ্রমিক কাজ করেছে। আজ আমাকে এখানে একমুঠো খাবারের জন্য ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
রোহিহঙ্গা নেতা ডা. আরিফ (৪৫)। যিনি গত ৪দিন আগে কোয়াইচং গ্রাম থেকে সপরিবারে রওয়ানা হয়ে প্রায় ২শ কিমি পথ অতিক্রম করে সীমান্তের আঞ্জুমানা পাড়া দিয়ে কুতুপালংয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি জানান, নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ইচ্ছের ওপর। কিন্তু বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাসরত কয়েক লাখ রোহিঙ্গা ভয় পাচ্ছে স্বদেশে ফিরতে। দেশে ফিরতে ভয় পাওয়ার কারণ কি, জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, মিয়ানমার সরকারের ওপর রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে পারছে না। স্থানীয় বৌদ্ধদের বিষয়েও আতঙ্ক কাজ করছে তাদের মধ্যে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর যারা গণহত্যা চালিয়েছে, সেই সেনাবাহিনী বলছে, শুধু অল্পসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। তাই রোহিঙ্গারা সে দেশে আবারো ফিরে যেতে সম্মত হয় কিনা তা নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে।
গত ২৫ আগস্টের পর থেকে শুরু হওয়া সেনাবাহিনীর নিপীড়নের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চল এখন কার্যত জনশূন্য।
জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব সমপ্রদায় ওই ঘটনাকে সরাসরি জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এরপর বিশ্ব সমপ্রদায়ের চাপে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার চুক্তি করলেও বিশেষজ্ঞরা এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। ইতোমধ্যে মিয়ানমারের অনেক কর্মকর্তা বলেছেন, ফিরিয়ে নেয়ার পর রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে রাখা হবে। এ লক্ষে নাকি দু’টি ব্যারাকও নির্মাণ করা হয়েছে। আর এ বিষয়টি নিয়ে শঙ্কায় আছেন রোহিঙ্গারা। তারা তাদের পিতৃভিটায় ফিরতে চান, যেখানে তারা বসবাস করেছেন কয়েক পুরুষ ধরে। কিন্তু সেনাদের তৈরি করা ক্যাম্পের বাসিন্দা হয়ে ফিরতে চান না রোহিঙ্গারা।
১৯৯১ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া মোহাম্মদ আলম (৩৪) জানান, সেনা অভিযানের সময় স্থানীয় রাখাইন বৌদ্ধরাও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনে সহায়তা করেছে। তাই তারা যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাইবে না, সেটি স্পষ্ট। তাদের অনুমতিসাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়টি সরকারের একটি অজুহাত বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ফেরত নেয়ার আগে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রমাণও দিতে হবে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার। কিন্তু অনেক বছর ধরেই রোহিঙ্গাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রও কেড়ে নেয়া হয়েছে। তাই নাগরিকত্বের স্বীকৃতি বিষয়ে কোনো প্রমাণ অনেকের কাছেই নেই।
উখিয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ সরকারের সাথে সম্পাদিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক চুক্তিতে বলা হয়েছে, এই প্রক্রিয়ায় জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশনের একটি ভূমিকা থাকবে। কিন্তু এখন দুই দেশের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় তাদের সংযুক্ত করা হচ্ছে না।
তাই সবকিছু মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার সরকার কতটা আন্তরিক হবে, সেটি নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। এছাড়াও বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের সংস্থাটিকে এই আলোচনায় রাখতে চাইলেও মিয়ানমার চাইছে না।
শেয়ার করুন
পাঠকের মতামত