প্রকাশিত: ০৮/১০/২০১৭ ৭:৪৬ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১২:৩৩ পিএম

গত বছর একজন উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠকের সময় মিয়ানমারের প্রধান বেসামরিক নেত্রী অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে নিজের সতর্ক অবস্থানের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইন্দোনেশিয়ার প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটির প্রসঙ্গ টেনে সু চি ওই কূটনীতিককে বলেছিলেন, ইন্দোনেশিয়ায় শত শত বছর ধরে সংখ্যালঘু থাকার পর মুসলমানরা এক পর্যায়ে দেশটির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। মিয়ানমারেও তেমন কিছু হোক, সেটি তিনি কোনোভাবেই চান না।

ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজনের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। কিন্তু ওই কূটনীতিকের পরিচয় প্রকাশ করেনি পত্রিকাটি।

মিয়ানমারের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৪ শতাংশ মুসলমান হলেও দেশটির কয়েকটি জায়গায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে।

গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর বর্বরতা ও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে এ সেনা অভিযানকে জাতিসংঘ ‘জাতিগত নিধনের সরাসরি উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

বিশ্বনের্তৃবৃন্দ, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্বসহ জাতিসংঘের কড়া নিন্দা সত্বেও সু চি এখনও পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এ সেনা অভিযানের নিন্দা করেননি।

সু চি’র নিকটজনদের মতে এ নীরব থাকাটা তার কৌশলের অংশ। তিনি এখনই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অবস্থান নিতে চান না। কারণ তিনি মনে করেন, তার এমন অবস্থান দেশটিতে পুনরায় সেনা শাসনের পথকে আরও প্রশস্ত করবে, মিয়ানমারকে গণতন্ত্রে পথে নিয়ে আসার জন্য তার যে বহু বছরের ত্যাগ, তাও ধুলায় মিশে যাবে।

যদিও মনে হচ্ছে সু চি তার বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিকে ‘বাঁচাতে’ ইন্দোনেশিয়ার উদারহণ সামনে আনছেন, তারপরও মিয়ানমারে মুসলমানদের নিয়ে বরাবরই দেশটির বৌদ্ধদের মনে ভয় কাজ করে।

২০১৩ সালে মিয়ানমার সফররত একজন বিদেশি কূটনীতিক রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সু চি’র দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘দয়া করে তাদেরকে রোহিঙ্গা বলবেন না। তারা বাঙালি। তারা বিদেশি।’ বৈঠকে উপস্থিত একজন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে এ তথ্য জানিয়েছেন। ওই বৈঠকে আন্তর্জাতিক নেতাদের চাপের সমালোচনা করে সু চি বলেন, রাখাইনের মুসলমানদের কারণে সংখ্যাগুরু রৌদ্ধরা যে ‘হুমকির’ মুখে পড়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা উপেক্ষা করছে।

‘বাঙালি’ শব্দটি মিয়ানমারে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বোঝাতে দেশটির মানুষ এ শব্দটি ব্যবহার করে। সু চি কিংবা সেনাবাহিনী, কেউই ‘রোহিঙ্গা’ নামটি উচ্চারণ করতে চান না। তাহলে রোহিঙ্গাদের কী নামে ডাকা হবে, এমন এক প্রশ্নের উত্তরে সু চির মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা তাদেরকে রাখাইনের মুসলিম জনগোষ্ঠী বলি। তাদের কোনো নাম দেওয়াটা আসলে খুব জটিল। তারপরও আমরা মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে তাদেরকে ‘বাঙালি’ বলি।’

রোহিঙ্গা ইস্যুতে তীব্র চাপের মুখে গত মাসে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন সু চি। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত একজন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে জানিয়েছেন সম্পূর্ণ চমকপ্রদ এক তথ্য। ওই ব্যক্তি পত্রিকাটিকে জানিয়েছেন, জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়ে চাপের ‍মুখে হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেনাবাহিনীর অবস্থানের ন্যুন্যতম সমালোচনা করলে কিংবা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যায়, এমন মন্তব্য করলে সু চিকে হয়তো আর মিয়ানমারে ফিরতে দিত না দেশটির সেনাবাহিনী।

এটা স্পষ্টই যে, মূলত সেনাবাহিনীর চাপেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চি’র নীরবতা। সু চি গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় আসলেও দেশটির মূল শাসনভার এখনও সেনাবাহিনীর ওপরই ন্যাস্ত। প্রতিরক্ষা, সীমান্ত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো এখনও সেনাবাহিনীর হাতে। আবার সেনাবাহিনী সাংবিধানিকভাবে সু চিকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে রেখেছে।

দীর্ঘদিন সেনাবাহীর কারণে গৃহবন্দী থাকলেও এবং সেনাবাহিনীর কারণে প্রেসিডেন্ট হতে না পারলেও সু চি সেনাবাহিনীর সমালোচনা থেকে বিরত রয়েছেন। সু চি তার ব্রিটিশ স্বামীকে মৃত্যুর সময় দেখতে যেতে পারেননি, বছরের পর বছর ধরে সন্তানদের সাথে দেখা করতে পারনেনি সেনাবাহিনীর কারণে। অথচ এখন তাকে সেই সেনাবাহিনীর সাথেই কাজ করতে হচ্ছে। ২০১২ সালে সিএনএন-এর সাংবাদিক ক্রিশ্চিয়ান আমারপোর সু চির প্রতি প্রশ্ন রেখেছিলেন, যাদের কারণে এত কষ্ট ও নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে, তাদের সাথে এখন কাজ করার অনুভূতি কেমন? উত্তরে সু চি বলেন, ‘আমি কখনও মনে করি না, সেনাবাহিনী ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে আমার প্রতি এমন আচরণ করেছে। অামি মনে করি এর পুরোটাই ছিল একটি রাজনৈতিক ঘটনা। রাজনীতিতে আসার জন্য আপনি যদি মনস্থির করে থাকেন, তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবলা করার জন্য আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।’

ওই সাক্ষাতকারে সু চি বলেন, ‘আমি অনেক জেনারেলকেই পছন্দ করি। আমার বাবা বার্মিজ আর্মির প্রতিষ্ঠাতা। তাই সেনাবাহিনীর প্রতি আমার সব সময়ই মায়া কাজ করে, যদিও তাদের সব কাজকেই আমি সমর্থন করছি না।’

সু চির এ মন্তব্যের পর তার সামনেই বিষ্ময় প্রকাশ করেন আমানপোর।

মিয়ানমারের সংবিধান দেশটির সেনাবাহিনীকে অনেক ক্ষমতা দিলেও সু চি বরাবরই খোলামেলাভাবে বলে আসছেন, তিনি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করতে চান, যেখানে বেসামরিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।

প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৬ লাখেরও বেশি। এদিকে পালিয়ে আসার হার আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও, তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে বলার সময় এখনও হয়নি বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মুখপাত্র।

সারা বিশ্বে ইউএনএইচসিআর কর্তৃক নিবন্ধিত ১৭.২ মিলিয়ন শরণার্থীর ৩০% এখন বাংলাদেশে। এরই মধ্যে চলমান রোহিঙ্গা ঢল অব্যাহত থাকলে শরণার্থীর এ সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে পারে বলেও সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।

গত ১১ আগস্টে রাখাইন রাজ্যে সেনা মোতায়েনের পর চলমান রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের কথা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ডেপুটি অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি প্যাট্রিক মার্ফি।

মিয়ানমার থেকে আবারও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামবে বলে ৬ অক্টোবর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ দফতরের প্রধান মার্ক লোকক।

পাঠকের মতামত

জাতিসংঘে প্রেসিডেন্ট পদে লড়বে বাংলাদেশ, প্রতিদ্বন্দ্বী ফিলিস্তিন

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮১তম অধিবেশনের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে বাংলাদেশ। এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ...

জাতিসংঘে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব বিপুল ভোটে পাস

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে হামাসমুক্ত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব বিপুল ভোটে পাস হয়েছে। ...

বিমান ছিনতাই করেছিলেন নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কির স্বামী

নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন দেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। দুর্নীতির ...