উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক সমস্যায় পড়েছে। সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশের ওপর। এই তিন খাতে বাংলাদেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ায় জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সংকট তৈরি হচ্ছে।কক্সবাজারে মোট বনভূমির পরিমাণ ২০ লাখ ৯২ হাজার ১৬ একর। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে ইতোমধ্যে বড় ধরনের বনভূমি ক্ষতির শিকার হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী অধ্যুষিত এলাকায় বায়ুদূষণ, ভূমিধসের মতো ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে জীবনজীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে বিষয়টি সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগাদা দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।জানা গেছে, সরকারের ব্যয়ের বোঝা বাড়াচ্ছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক। সরকার এদের খাদ্য, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের জন্য জাতীয় বাজেট থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে। তবে আইওএম, ইউএনএইচসিআরসহ বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন-সহযোগীর কাছ থেকে পাওয়া ত্রাণ সহায়তার অর্থ দিয়ে এ ব্যয় সমন্বয় করা হবে বলে জানিয়েছে অর্থ বিভাগ।এদিকে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢল, ভূমিধস, জলোচ্ছ্বাসসহ সম্ভাব্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে অন্তত দুই লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। দ্রুত এদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া সম্ভাব্য এই দুর্যোগ মোকাবিলায় বর্ষা মৌসুমে আরও অতিরিক্ত তিনশ কোটি টাকার প্রয়োজন হতে পারে বলে জানানো হয়েছে অর্থ বিভাগকে। গত ১৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বৈঠকের কার্যপত্র ঘেঁটে এসব তথ্য জানা গেছে।‘আসন্ন বর্ষাকালে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়, পাহাড়ি ঢল ও পাহাড়ধস থেকে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের রক্ষায় প্রস্তুতি গ্রহণ শীর্ষক’ ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান। এ ছাড়া বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগের সচিব, কোস্টগার্ড, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।সূত্র জানায়, উখিয়া ও কুতুপালং ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এদের মধ্যে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৪৯ জন ভূমিধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। আর ৬৯ হাজার ৩৫১ জন রয়েছে বন্যার ঝুঁকিতে। এ জন্য এই ২ লাখ ৩ হাজার মানুুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ইতোমধ্যে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা নাগরিককে এসব জায়গা থেকে সরিয়েও নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কুতুপালং ও উখিয়া ক্যাম্পের প্রায় দুইশ একর জায়গায় নতুন করে কিছু স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে খাদ্য, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন খাতে। এ তিন খাতে মার্চ পর্যন্ত প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ ছাড়া ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য স্থায়ী অবকাঠামো তৈরির কাজও শুরু হয়েছে।জানা গেছে, নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার ভাসানচর প্রকল্পের আওতায় মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে দ্বীপটিতে ভাঙন প্রতিরোধব্যবস্থাসহ বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বাসস্থান সুবিধা, সুপেয় পানি, পয়োব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি নিষ্কাশন, পুকুর খনন, স্কুল, মসজিদ, অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন, সাইক্লোনশেল্টার স্টেশন, দুইটি হেলিপ্যাড নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সাময়িক বসবাসের জন্য ১৩ হাজার একর খাস জমি চিহ্নিত করে বসবাসের উপযোগী করা হয়েছে। এতে একটি হেলিপ্যাড, কিছু টয়লেট, চারটি শেড ও সীমিত পরিসরে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এসব কাজে সরকারের ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি টাকা।অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে ৭১টি প্রকল্প হাতে নেওয়ার প্রস্তাব করেছে দেশি-বিদেশি ৪২টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও)। এ জন্য সরকারের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদনও করেছে এনজিওগুলো। প্রকল্প বাস্তবায়নে ৪২ এনজিওর পক্ষ থেকে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের কাছে অনুমতির জন্য আবেদন করা হয়েছে। ৭১ প্রকল্পে ২০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কয়েকটি এনজিওকে কাজের অনুমতিও দেওয়া হয়েছে।জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বাড়তি চাপ। শুধু নিরাপত্তার জন্যই নয়Ñ এসব রোহিঙ্গা নাগরিকের খাদ্য, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করে জাতিসংঘ।এ ছাড়া কক্সবাজারের যে এলাকায় রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে, সেটাও ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য একটা বড় ধরনের হুমকি বলে মনে করে জাতিসংঘ। এসব ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা, যা সরকারের অপ্রত্যাশিত ব্যয়।জানা গেছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অপ্রত্যাশিত খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ২ হাজার কোটি টাকা। বছরের শুরতেই এ খাত থেকে ৩০০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আগামী বছরের বাজেটে রোহিঙ্গাদের জন্য পৃৃথক বরাদ্দ রাখা হবে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। অবশ্য পরবর্তীতে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। এ জন্য অপ্রত্যাশিত খাতেই বরাদ্দ বাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন খরচ মেটাতে হবে।এদিকে রোহিঙ্গা নাগরিকদের ফেরত নিতে গত বছরের শেষদিকে জোরালো আলোচনা হয়। সে সময় জানুয়ারি মাসে প্রথম কিস্তিতে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গাকে নাগরিক ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয় মিয়ানমার। কিন্তু পরবর্তীতে কোনো কারণ ছাড়াই তা ভেস্তে যায়। এমন কি মিয়ানমার তাদের নাগরিদের আদৌ ফেরত নেবে কিনা, সেটাও নিশ্চিত নয়।
পাঠকের মতামত