ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ২৮/১১/২০২৫ ৪:১১ পিএম

পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন সেন্টমার্টিন দ্বীপকে রক্ষায় অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সুরক্ষা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রস্তুত করা খসড়া মাস্টারপ্ল্যান সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে।

গত সোমবার (২৪ নভেম্বর) এ পরিকল্পনাটি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ওয়েব পোর্টালের নোটিশ বোর্ডে উন্মুক্ত করা হয়েছে। আগামী ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে লিখিতভাবে সংশ্লিষ্টদের মতামত দিতে বলা হয়েছে।

এর আগে, চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছিলেন, দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হবে এবং এ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করা হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে সব নারী কুকুরের বন্ধ্যা করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ কুকুরের বন্ধ্যা করা সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

মাস্টারপ্ল্যানের খসড়ার বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ অনুবিভাগ) ড. ফাহমিদা খানম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “সেন্টমার্টিনে অনেক বিরল প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে। এই জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মাস্টারপ্ল্যানের খসড়া করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট যে কেউ এ বিষয়ে মতামত দিতে পারেন। মতামতের ভিত্তিতে মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত হবে।”

খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২৬টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ৫৪৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন টাকা।

খসড়ায় কুকুর বন্ধ্যা করা কর্মসূচিতে বলা হয়েছে, সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। অনুমান করা হয় দ্বীপে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ থেকে ৪ হাজার ৫০০ ফেরারি কুকুর রয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৭ শতাংশ কুকুরের প্রজনন ক্ষমতা বন্ধ করা বা বন্ধ্যা করা (নির্বীজকরণ) হয়েছে।

মাস্টারপ্ল্যানে দ্বীপে কুকুরের সমস্যার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়ে বলা হয়েছে, স্থানীয় ও পর্যটক উভয়কে কুকুর কামড়ানোর ঘটনা ঘটে। এতে রেবিসসহ বিভিন্ন রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। আতঙ্কের কারণে মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরায় অসুবিধা বোধ করেন।

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির বিষয় উল্লেখ করে বলা হয়, এই কুকুর কচ্ছপের ডিম ও বাচ্চাদের আক্রমণ করে। দ্বীপের প্রাকৃতিক বন্যপ্রাণী ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

প্রাণী কল্যাণের সংকট উল্লেখ করে বলা হয়, পর্যটন মৌসুম না থাকলে খাবারের অভাবে কুকুরগুলো ক্ষুধায় কষ্ট পায়। অনেক কুকুর রোগে আক্রান্ত, আহত ও অপুষ্টিতে ভুগছে।

সামাজিক ও পর্যটন খাতের কুকুরের প্রভাব উল্লেখ করে বলা হয়, পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়, যা দ্বীপের পর্যটন খাতের জন্য নেতিবাচক। স্থানীয়দের দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হয়।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা সৃষ্টির বিষয় উল্লেখ করে মাস্টারপ্ল্যানে বলা হয়, কুকুরগুলো হোটেল-রেস্তোরাঁর ফেলে দেওয়া খাবারের ওপর নির্ভর করে। পর্যটন মৌসুমে খাবার বেশি থাকে, অফ-সিজনে অভাব দেখা দেয়।

এ বিষয়ে পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রকল্প পরিচালক ব্যারিস্টার রাবাব চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “এভাবে যদি বন্ধ্যা করা হতে থাকে তাহলে সেখানে কুকুর বিলুপ্ত হতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের সার্ভে বলছে যে এটা (বন্ধ্যা করা) শতভাগ সম্ভব না। কারণ, সেন্টমার্টিন একটা দ্বীপ, সেখানে কোনও না কোনোভাবে কুকুর গেছে। অবশ্যই শিপে করে যায়নি? সেখানে যতই বন্ধ্যা করা হোক না, শতভাগ সম্ভব হবে না। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কুকুরদের প্রজনন বা বংশবৃদ্ধির সময় মারামারি করে। বন্ধ্যা করলে মারামারি বন্ধ হবে। মা কুকুরগুলো অ্যাগ্রেসিভ হয়ে যায়। এটা ন্যাচারাল। তখন মানুষ ভাবে কুকুর পাগল হয়ে গেছে, আর তখন তাকে পিটিয়ে মারে। তাছাড়া অনেক সময় ক্ষুধায় মারা যাওয়ার চেয়ে এইটা ভালো। বন্ধ্যা করা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। অন্যান্য রোগও বাড়ে। তবে সেখানে বিলুপ্ত হবে না। বিলুপ্ত করা সহজ নয়।”

যেসব উদ্যোগ রয়েছে মাস্টারপ্ল্যানে

কুকুর নির্বীজকরণ (বন্ধ্যা করা) কার্যক্রম, টিকাদান কর্মসূচি, গণনা ও জরিপসহ বেশ কিছু কর্মসূচি রয়েছে মাস্টারপ্ল্যানে। এতে জানানো হয়, সরকার ইতোমধ্যে প্রায় ১ হাজার ৯১৭টি কুকুরকে টিকা দিয়েছে। দ্বীপে কুকুরের সংখ্যা, স্বাস্থ্য ও নির্বীজকরণের অবস্থা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু কুকুরকে বন্ধ্যা (স্পে/নিউটার) করা হয়েছে। খাওয়ানো নিয়ন্ত্রণ, নতুন পোষা প্রাণী আনা বন্ধ, পোষা কুকুরের নির্বীজকরণ করা, প্রাণী-যত্ন ও সতর্কতা বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হবে।

মাস্টারপ্ল্যানে জানানো হয়, ২০২৫ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ নির্বীজকরণ, ২০২৬ সালের মধ্যে সব মাদি কুকুর নির্বীজকরণ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।

কুকুর বন্ধ্যা করা চ্যালেঞ্জ

মাস্টারপ্ল্যানে জানানো হয়, নির্বীজকরণের হার এখনও খুব কম। পর্যাপ্ত তহবিল ও জনবলের ঘাটতি রয়েছে। খাবারের টেকসই ব্যবস্থা নেই। আইনগত ও নৈতিক বিতর্ক (যেমন স্থানান্তর বা কুকুর নিধন)। স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকদের আচরণ পরিবর্তন করা কঠিন।

দ্বীপে প্রাণীর পরিসংখ্যান

সেন্টমার্টিন দ্বীপে বন্যপ্রাণী রয়েছে ১৯৪টি প্রজাতির। এর মধ্যে ছোট বেজি, বড় বাদুড়সহ ১৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী রয়েছ। বাসিন্দা, অভিবাসী ও দর্শনার্থী পাখি রয়েছে ১৫৯ প্রজাতির। গোখরা, রক্তচোষা, গুইসাপসসহ ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে। রয়েছে মিঠাপানির কচ্ছপও। তবে গবেষণা অব্যাহত রাখলে আরও প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সেন্টমার্টিনে মাছ রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির। দ্বীপে অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে ৯টি একাইনোডার্ম প্রজাতির এবং ১৮৭টি মোলাক্স প্রজাতির। ক্রাইটোসিয়ানদের মধ্যে ১২টি কাঁকড়া এবং ২৬টি চিংড়ি প্রজাতির।

পাঠকের মতামত