ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ১৬/০৫/২০২৩ ৯:৫০ এএম

“একটা পান চাইলাম পান দিলানা,
তোমার সাথে কিসের ফিরিতি”
“টেন্নাইপ্পা গোল সুয়ারি,মুইশখাইল্যা পানরে, আদর গরি হাবাই দিতাম আর তালত বইনরে”
“যদি সুন্দর একখান মুখ পায়তাম,যদি নতুন একখান মুখ পায়তাম,
মহেশখালীর পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম”
উপরিউক্ত সবগুলো গানেই পানের গুন কীর্তন করা হয়েছে।বাঙ্গালি সমাজে পানের কদর আবহমানকাল থেকে চলে আসছে।এখনো অতিথি আপ্যায়নে পানের ব্যবহার বেশ গ্রহনযোগ্য ও কদর্য।
এবার আসি মূল আলোচনায়।গত ১৪ মে-২০২৩ইংরেজি তারিখে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপকূল হয়ে মায়ানমারে আঘাত হানে।এত উভয় দেশে কমবেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়।বিশেষ করে আমাদের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন ও সাবরাং ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।কর্মসূত্রে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানার দুইদিন আগে থেকে আজ অবধি তার গতিবিধি ও স্মৃতি চিহ্ন পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ আমার হয়েছে।১৫ মে-২০২৩ তারিখে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ সরেজমিনে দেখার জন্য বের হলে টেকনাফ এলাকার পান চাষিদের বোবা কান্না শুনতে পাই।কেবল বিবেকের তাড়নায় এই লেখাটি সম্মানীয় পাঠদের সম্মুখে তুলে ধরা হলো।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নোয়াখালী পাড়া থেকে শুরু করে সাবরা ইউনিয়নের শাহ পরীরদ্বীপ পর্যন্ত শত শত পানের বরজ মাটির সাথে সম্পূর্ণ লুটিয়ে পড়ছে।প্রাথমিকভাবে মনে হবে বাঁশের পুরনো কোন মাঁচা হয়ত শুয়ে আছে।কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি একেকটা জীবন্ত প্রাণ,সবুজ পাতায় ভরা লাতানো লতানো পানের গাছ।এতেই লুকিয়ে ছিল উপকূলের পান চাষিদের ভাগ্য। হাসি আনন্দের খোরাক।একটা নয় দুইটা নয় এরকম প্রায় আড়াইশ পানের বরজ।
কেমন খরচ পড়ে একেকটা পানের বরজ তৈরিতে? স্থানীয় পান চাষিদের সাথে কথা বলে জানা গেল,জমি ভাড়া নেওয়া,চারা রোপন,বাঁশও শনের বেড়া তৈরি, পানের খুটি, সার ও সেচ খরচ ইত্যাদি মিলিয়ে একেকটা মাজারি সাইজের বরজ তৈরিতে ন্যুনতম খরচ পড়ে দুই লক্ষ টাকা।এর বাইরে নিয়মিত পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচত রয়েছেই।সবকিছু ঠিকঠাক মতো থাকলে চারা রোপনের প্রায় আড়াই থেকে তিন মাস পর থেকে পান তোলা আরম্ভ করা যায়।স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থ পানচাষি মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম জানান সাম্প্রতিক মোখা ঘূর্ণিঝড়ে তার দুইটি বরজ সম্পূর্ণ নস্ট হয়েছে।একটি ছিল অপেক্ষাকৃত নতুন।নতুন বরজ থেকে কেবল পান তোলা/ছেঁড়া শুরু করছেন।ইতিমধ্যে সে ২/৩ বার পান বাজারে বিক্রিও করছেন।তার ক্ষতিগ্রস্থ পানের বরজে মোট ষোল হাজার পানের চারা রোপন করেছিল গত চার মাস আগে।কিছুদিন আগে এই বরজ থেকে সে একদিনেই সাইঁত্রিশ হাজার টাকার পান বাজারজাত করেন।তার ভাষ্যমতে আর কিছুদিন থাকলে তার মূলধন উঠে এসে লাভের মুখ দেখতে পেত।টেকনাফ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জনাব জাকির হোসেনের কথায়ও চাষি নুরুল ইসলামের কথার সত্যতা পাওয়া গেল।কৃষি কর্মকর্তা জানান এক কানি (চল্লিশ শতক) জমি থেকে এক সিজনে বা সাত-আট মাসে প্রায় নয় লাখ টাকার পান বিক্রি করা সম্ভব যা মোট খরচের প্রায় তিনগুণেরও অধিক।
গুনগত মানের কারণে টেকনাফ এলাকার পান সুপারি চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র সরবরাহ হয়।বেপারিরা প্রায় প্রতিদিন টেকনাফ বাজার থেকে এই সব পান সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করতে নিয়ে যায়।স্থানীয় বাজারে বড় সাইজের এক বিরা পানের বর্তমান মূল্য তিন’শ থেকে সাড়ে তিন’শ টাকা।
স্থানীয় লোকজন ও জনপ্রতিনিধিদের মতে টেকনাফে সবথেকে বেশি পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে উপকূলীয় ইউনিয়ন সাবরাং,টেকনাফ সদর ইউনিয়ন ও বাহারছড়া ইউনিয়নে। তাদের মতে উপরিউক্ত তিন ইউনিয়নে প্রায় দুইশ থেকে তিনশ বরজ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।যার প্রতিটির ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক দুইলক্ষ টাকা।সে হিসাবে দুই’শ পঞ্চাশটি পানের বরজের অনুমিত ক্ষতি পাচঁ কোটি টাকা।
প্রতিটা বাড়িতে সুপারিগাছও নস্ট হয়েছে উল্লেযোগ্য সংখ্যক।পানের সাথে যেহেতু সুপারিরও অর্থনৈতিক মূল্য ভালো সুতরাং সুপারিগাছের ক্ষতি নিরুপন একান্ত জরুরি।স্থানীয় লোকদের মতে প্রতিটা সুপারিগাছ থেকে তারা গড়ে প্রতি বছর একহাজার টাকার সুপারি বিক্রি করতে পারেন।একটা সুপারি গাছ যদি আগামী দশ বছর একই পরিমাণ সুপারি দেয় তাহলে দশ হাজার টাকা।ধরি এক লক্ষটি গাছ সম্পূর্ণ ভেঙ্গেগেছে।সে অনুযায়ি এক বছরের মোট অনুমেয় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় দশ কোটি টাকা।কেবল পান সুপারির ক্ষতিই হলো পনের কোটি টাকা।তাও কেউ কেউ হয়ত বলবেন এবারের ঘূর্ণিঝড়ে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।এমন মন্তব্য করার আগে আক্রান্ত এলাকায় গিয়ে সচক্ষে একবার দেখে আসার অনুরোধ রইল।
যেহেতু শোয়ে পড়া বরজে পানের চারা এখনো বেচেঁ আছে অতিদ্রুত যদি এদের পূর্বাস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে কৃষিকের মুখে আবারো হাসি ফোঁটা সম্ভব। এই জন্য প্রয়োজন তাদের কিছু নগদ অর্থ সহায়তা যা দিয়ে তারা অতিরিক্ত শ্রমিকের মজুরি ও প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতে পারবে।কৃষি বিভাগ ক্ষতিগ্রস্থ পান চাষিদের তালিকা প্রণয়ন করে প্রয়োজনীয় কারিগরি ও তথ্যগত সহায়তা প্রদান করতে পারে।সরকারের পাশাপাশি দেশে বিদেশি সাহায্যকারী সংস্থা এই কৃষিপণ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে পারে।কৃষক বাচঁলে বাচঁবে দেশ এই মন্ত্র সবসময়ই মনে রাখা প্রয়োজন।আসুন পান চাষিদের এই বোবা কান্না বন্ধ করে তাদের পাশে দাঁড়ায়।

লেখক,
জিয়াউর রহমান মুকুল,
উপ-পরিচালক,
শেড,কক্সবাজার।
ইমেইল:[email protected]

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...

একটি ফুল—

একটি ফুল, একটি ফুলের জন্যে কতো নিষ্পাপ গাছ প্রাণ হারালো, এই বর্বর শুকোনের দল বারংবার ...