প্রকাশিত: ১৬/০৬/২০১৭ ৩:১৫ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৪:২৬ পিএম

ডেস্ক রিপোর্ট ::
রাঙামাটি শহরের ভেদভেদি পোস্ট অফিস কলোনিতে গতকাল সকালে স্বজনহারার কান্না ভেসে আসে। পাহাড়ধসে মাটিচাপা পড়া দুই ভাইয়ের মধ্যে সুমন দত্তের (২৪) মরদেহ মঙ্গলবারই মাটি খুঁড়ে বের করা হয়। গতকাল সকালে যখন স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা রূপন দত্তের (২০) মরদেহ মাটি খুঁড়ে বের করে আনছিলেন, তখন পাশে দাঁড়িয়ে বুকফাটা কান্না বড়বোন শীলা দত্তের। বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘অ ভাই, তোরা কিল্লাই গিয়ছগই। আরেক্যা ফাঁকি দি ফেলাই গিয়ছ। এতল্যায় নে তোরারে ন হাই হাবাইদে?’ (ভাই, তোরা কেন চলে গেলি। আমাকে ফাঁকি দিয়ে ফেলে গেলি। এ জন্যই কি নিজে না খেয়ে তোদের খাইয়েছিলাম?)

বাবা বাদল দত্ত আর মা বুলু দত্ত তখনও হাসপাতালে। বাবা জানলেও মা জানেন না দুই ছেলের মৃত্যুর কথা।

এর আগে গতকাল সকালে শহরের সার্কিট হাউসের পেছনে হ্রদের পানিতে ভাসা অবস্থায় স্মরণী বেগম (৪০) নামের এক নারীর লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। একই সময়ে মানিকছড়ির শালবন সেনা ক্যাম্পের পাহাড়ধসে নিখোঁজ সেনাসদস্যের মরদেহও উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে গতকাল তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে বুধবার পর্যন্ত রাঙামাটিতে ১০৫ জনের লাশ উদ্ধারের কথা জানান জেলা প্রশাসক মো. মানজারুল মান্নান। উদ্ধার অভিযান চলাকালেই গতকাল দুপুর থেকে পাহাড়ে ভারী বর্ষণ শুরু হয়েছে। একদিন বন্ধ থাকার পর শুরু হওয়া বৃষ্টির কারণে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হতে পারে বলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ধারণা করছেন।

চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. জসিমউদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত সর্বশেষ তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করেছি আমরা। বৃষ্টি সত্ত্বেও উদ্ধারকাজ অব্যাহত রয়েছে, যদিও আমাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। জসিমউদ্দিন ও তার দলের লোকজন রাঙামাটিতে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন।

পাহাড়ধসে সৃষ্ট বিপর্যয়ের পর গত চার দিন ধরে উদ্ধারকর্মী ও প্রশাসনের লোকজন রাঙামাটি শহরের বাইরেই যেতে পারেননি। জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান বলেন, শহর থেকে বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। এ জন্য আমরা শহরের বাইরে যেতে পারছি না। আমরা সেখানকার বিপর্যস্ত মানুষের পাশে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না। তবে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক থেকে পাহাড়ধসে আসা মাটি ও গাছপালা অপসারণের কাজ গতকাল থেকে শুরু হয়েছে বলে দাবি করেন জেলা প্রশাসক।

গতকাল বিকালে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস এবং সামরিক বাহিনীর লোকজন রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া এলাকা থেকে সড়কের মাটি অপসারণের কাজ শুরু করেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সড়কটি পরিষ্কার করার কাজ শেষ হবে।

রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এমদাদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে ঘাগড়া এলাকায় সওজের দুটি এবং সেনাবাহিনীর একটি পে লোডার সড়কের মাটি অপসারণের কাজ করছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে আগামী তিন থেকে চার দিনের মধ্যে পুরো সড়ক পরিষ্কার করে হালকা যান চলাচল করা যায়। তবে বড় গাড়ি চলতে আরও ১০ থেকে ১২ দিন লেগে যেতে পারে।

শহরের সঙ্গে বাইরের সড়ক যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ থাকায় বিভিন্ন ফিলিং স্টেশনগুলোতে জ্বালানি তেলের মজুদও ফুরিয়ে এসেছে। রাঙামাটি শহরে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানীয় জল সরবরাহ করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ। গত বুধবার পর্যন্ত ভাউজারে করে পানীয় জল সরবরাহ করা হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার তা বন্ধ হয়ে যায়। রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে আমাদের সময়কে বলেন, জ্বালানি তেল ফুরিয়ে গেছে। তাই আমাদের চারটি পানি শোধনাগারও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ভাউজারে করে আর পানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় আজ (বৃহস্পতিবার) শহরবাসীর মধ্যে ৫০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি বিতরণ করা হয়েছে। আরও ৮০ হাজার বড়ি আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পাহাড়ধসের কারণে পানি সরবরাহের পাইপলাইনও ভেঙে গেছে।

গতকাল দুপুরে বনরূপার পার্শ্ববর্তী তান্যাবি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ফিলিং স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, জ্বালানি তেলের জন্য মানুষের দীর্ঘ লাইন। এখানকার মালিক কংকন চাকমা আমাদের সময়কে বলেন, প্রতি লিটার ৯০ টাকা করে প্রত্যেককে ৩ লিটার করে অকটেন বিক্রি করছি। ডিজেল আগেই শেষ হয়ে গেছে। আজকের মধ্যে অকটেনও শেষ হয়ে যাবে।

তবে ফিলিং স্টেশনের বাইরে বিভিন্ন দোকানে প্রতি লিটার অকটেন ১৪০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে বলে জানান অটোরিকশার চালকরা।

এদিকে গতকাল বিকালে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিটি পরিবারকে নগদ ২০ হাজার টাকা আর ৩০ কেজি করে চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঘর তৈরির জন্য তিন বান করে ঢেউটিন দেওয়া হবে।

সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা রাঙামাটি শহরের সঙ্গে কাপ্তাইয়ের জরুরিভিত্তিতে যোগাযোগ শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এজন্য আজ শুক্রবার থেকে চারটি পরিবহন বোট রাঙামাটি ও কাপ্তাই নৌবাহিনী ক্যাম্পের মধ্যে চলাচল করবে। রাঙামাটি হ্রদের পানি বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে যান চলাচল শুরু হয়েছে।

তবে জেলা প্রশাসন ঘোষণা দেওয়ার আগেই ব্যক্তি উদ্যোগে কাপ্তাই ও রাঙামাটির মধ্যে ইঞ্জিনচালিত পরিবহন বোটের চলাচল শুরু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কাপ্তাই হ্রদ দিয়ে রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই যেতে যেতে দেখা যায়, স্বল্প যাত্রী নিয়ে সীমিত সংখ্যক বোট চলাচল করছে। অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে এই পথে যাত্রীরা কম চলাচল করছে। তবে কাপ্তাই থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও জ্বালানি তেল নিয়ে যেতে দেখা যায়। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় জলপথে যেতে একজন যাত্রীকে কয়েকগুণ বেশি টাকা ভাড়া হিসেবে গুণতে হয়। স্পিডবোটে এই পথে ভাড়া তিন হাজার টাকা। গতকাল নেওয়া হয় পাঁচ হাজার টাকা।

পাঠকের মতামত