প্রকাশিত: ০৯/০৮/২০২০ ৭:১৫ এএম

মোহাম্মদ ওমর ফারুক, টেকনাফ থেকে ::
বেলা এগারোটা। কক্সবাজারের টেকনাফ থানা। প্রধান ফটকের সামনে বেশ কয়েকজন লোকের জটলা। একেকজনের একেক অভিযোগ। কিন্তু থানায় কেউ প্রবেশ করতে পারছেন না। থানার প্রবেশদ্বার বন্ধ। গেটের অপর প্রান্ত থেকে একজন আনসার সবাইকে বলে দিচ্ছেন, থানা গরম, প্রবেশ নিষেধ। আমার জান গেলেও আমি ঢুকতে দিতে পারবো না।

আপনারা চলে যান। গতকাল সরজমিনে দেখা গেছে টেকনাফ থানার এমন দৃশ্য। গত ৩১শে জুলাই পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন টেকনাফ থানার পুলিশ সদস্যরা। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তারা খুব একটা বাইরে বের হচ্ছেন না।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে থানার মূল প্রবেশপথটি বন্ধ রয়েছে। ফলে থানায় সহযোগিতা চাইতে এসে বিপাকে পড়ছেন ভুক্তভোগীরা। কারো মামলা বা জিডির মতো ঘটনা নিয়ে এলেও কোনো সহযোগিতা করছেন না পুলিশ সদস্যরা। সবাইকে বলে দিচ্ছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে থানায় আসার জন্য।
তেমনি একজন জহির উদ্দিন। প্রায় বাইশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হ্নীলা থেকে থানায় এসেছেন কোর্টের একটি নির্দেশনা নিয়ে। কিন্তু সকাল ৯টায় এলেও বিকাল চারটা পর্যন্ত তিনি থানায় প্রবেশ করতে পারেননি। জহির উদ্দিন বলেন, আমার একটি জমি নিয়ে ঝামেলা চলছে। কোর্ট আমার পক্ষে রায় দিয়েছেন। পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছেন জমিটি উদ্ধার করে দিতে। কিন্তু পুলিশ কোনো ভূমিকা পালন করছে না। আর এখন থানার ভিতরে প্রবেশ করতে পারছি না। আট নয় ঘণ্টা ধরে বসে আছি। পুলিশের পায়ে ধরার বাকি। কিন্তু কেউ কথা শুনছেন না। আরো একজন ভুক্তভোগী আবুল হোসেন। মোবাইল ফোন চুরির জিডি করতে এসেছেন থানায়। তাকেও প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তবে ঘণ্টাতিনেক পরে তার জিডির কপিটি একজন পুলিশ সদস্য নিয়ে জমা দিয়েছেন। কিন্তু তাকে থানার ভেতর প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, কথিত ক্রসফায়ারে নিহত আব্দুল জলিলের স্ত্রী ছেনুয়ারা বেগম গত চারদিন ধরে ঘুরছেন থানার আশেপাশে। উদ্দেশ্য স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে অভিযোগ করবেন। তাকেও থানায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি। ছেনুয়ারা বেগম বলেন, আমার স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার কয়েক মাস পর তাকে তারা মেরে ফেলে। ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমি এসপি অফিসে অভিযোগ করলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি। এসপি তখন আমার অভিযোগ আমলে নিলে আমার স্বামীকে হারাতে হতো না। কিন্তু ওসি প্রদীপ আমার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে আমার স্বামীকে মেরে ফেললো।

সকাল ১১টা থেকে চারটা। এ সময় এমন নানান অভিযোগ নিয়ে আসা প্রায় ৩৫ জন ভুক্তভোগীকে ফিরিয়ে দিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। গত এক সপ্তাহ ধরে এমন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এই থানার বাসিন্দারা। এর আগে গত ৬ই আগস্ট টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ আদালতে আত্মসমর্পণ করার পরে স্থানীয় ভুক্তভোগী বাসিন্দারা থানায় এসে প্রতিবাদ জানান। ওইদিন বিভাগীয় তদন্ত টিম আসার খবরে উৎসুক জনতা ও ভুক্তভোগীরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন। ওইদিন ছিল একেকজনের একেক অভিযোগ। অভিযোগকারীরা বলছেন, ওসি প্রদীপসহ থানায় অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা কারো কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, আবার কারো কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিয়েছেন কথিত ক্রসফায়ার। তবে গত সাতদিন ধরে এসব অভিযোগ করতে গেলে তাদের থানায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। থানার পাশে বাড়ি এমন একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে থানার মূল প্রবেশপথটি বন্ধ রয়েছে। কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। কারো কোনো অভিযোগ নেয়া হচ্ছে না। তবে এই থানার পুলিশ সদস্যরা খুব ভয়ে রয়েছেন। তারাও তেমন একটা বের হচ্ছেন না। শুধু খাবার-দাবারের জন্য বের হচ্ছেন। তাদের কার্যক্রম আগের মতো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তাছাড়া বাহারছড়া শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও ওই ঘটনার পর সেখানে বর্তমানে বিজিবি সদস্যদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এর বাইরেও টেকনাফ থানার পুলিশ স্বাভাবিক কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছে বলে জানা গেছে।

টেকনাফ থানার এক পুলিশ সদস্য এই প্রতিবেদকে বলেন, থানার অবস্থা খুব বাজে। সাধারণ মানুষ আমাদের বিশ্বাস করতে পারছে না। ওসি স্যারের ঘটনার পর অনেক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে আমাদের ওপর। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে আমাদের চলাচল একটু সীমিত রাখার নির্দেশ দেয়া আছে। তাই আমরা নিজেরাও বের হচ্ছি না। এবং সাধারণ মানুষকেও থানায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৬ই আগস্ট থানায় জনসমাগম ঘটিয়ে প্রতিবাদ করার পর থেকে থানার সামনে কয়েকটি গাড়ি রাখা হয়েছে। যাতে করে বেশি মানুষের সমাগম না ঘটে। সরজমিন গিয়েও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, এই প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিয়ে থানায় কয়েকবার প্রবেশ করতে চাইলেও প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া গতকাল সারাদিন টেকনাফ থানার ওসির সরকারি নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। থানার প্রবেশমুখের দায়িত্বে থাকা দুই আনসার সদস্যকে বলার পর তারা ওসি তদন্ত (ভারপ্রাপ্ত) এবিএমএস দোহার কাছে গেলে তিনিও দেখা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে তারা ফিরে এসে বলেন, নতুন ওসি জয়েন করলে সাংবাদিকদের ডাকা হবে, এর আগে থানার কেউ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে থানার ডিউটি অফিসারের দায়িত্বে থাকা সাব ইন্সপেক্টর সঞ্জয় দত্ত এই প্রতিবেদকে বলেন, থানায় প্রবেশ নিষেধ বিষয়টি ঠিক না। আজকেও কয়েকটি জিডি নিয়েছি। কিন্তু এই প্রতিবেদক প্রমাণসহ কয়েকজন ভুক্তভোগীর নাম উল্লেখ করলে তিনি কিছু না বলে ফোনটি রেখে দেন।

সুত্র- মানবজমিন

পাঠকের মতামত

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এলেন আরও ৫৯ সেনা-বিজিপি সদস্য

আরাকান আর্মির হামলার মুখে ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্ত ফাঁড়ির ...