প্রকাশিত: ০৯/০৯/২০১৮ ৮:০০ এএম , আপডেট: ০৯/০৯/২০১৮ ৯:২৫ এএম
পাসপোর্ট করতে গিয়ে আটক দুই নারী

ফারুক তাহের::

পাসপোর্ট করতে গিয়ে আটক দুই নারী

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট এবং জন্মনিবন্ধন তৈরি করে দিতে দেশব্যাপী একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। টাকা দিলেই মিলছে পাসপোর্ট ও জন্মনিবন্ধন সনদ। তবে স্বাভাবিক কারণে কক্সবাজারসহ চট্টগ্রাম বিভাগেই এই চক্রটি বেশ সক্রিয় বলে জানা গেছে। জনপ্রতি ৩০-৩৫ হাজার টাকা নিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। আর চার-পাঁচ হাজার টাকায় মিলছে জন্মনিবন্ধন সনদ। এই জন্মনিবন্ধন সনদকেই বাংলাদেশি জাতীয় সনদের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ নিয়ে রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট তৈরিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সহজেই বাংলাদেশি বেশ ধারণ করছে। আবার বাংলাদেশি সেজে প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিদেশে গমনকালে বহু রোহিঙ্গা নাগরিক আটক হচ্ছেন পুলিশ ও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের হাতে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে এ পর্যন্ত দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে বিদেশে চলে গেছে বলে জানিয়েছেন খোদ প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি। অতিসম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর এনআরবি-ননরেসিডেন্ট বাংলাদেশি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী অকপটে এ কথা বলেন।

এদিকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও জন্মনিবন্ধন সনদ প্রাপ্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ (যুগ্ম-সচিব) মো. রেজাউল করিম বলেন, যে কোনো মূল্যে রোহিঙ্গাদের অবৈধ উপায়ে পাসপোর্ট ও জন্ম সনদ প্রাপ্তির বিষয়গুলো বন্ধ করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে এ দেশকে। এখনো বিদেশি শ্রমবাজারে রোহিঙ্গাদের কারণে বাঙালিদের দুর্নাম হচ্ছে এবং শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে আসছে।

এদিকে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার একটি বড় সিন্ডিকেট। তারাই মূলত মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আঁতাত করে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ও জন্মনিবন্ধন সনদ পাইয়ে দিয়ে থাকেন। নিজ জেলায় সুবিধা করতে না পারলে দালাল চক্রটি দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে গিয়ে পাসপোর্ট ও জন্মনিবন্ধন সনদ প্রাপ্তির বিষয়ে চেষ্টা চালায়। স্থানীয় ও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দালাল চক্রের সদস্যদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন উখিয়ার মো. হারুন, পিতা ছৈয়দ নূর; দিদারুল আলম, পিতা নুরুল আলম; শামসুল আলম ও নুরুল আলম, পিতা- অজ্ঞাত। টেকনাফের দালালদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন—হোছন আহমদ, নাইট্যংপাড়া, টেকনাফ পৌরসভা; মো. শফিক, শাহপরীর দ্বীপ মাঝেরপাড়া; মৌলভী আজম উল্লাহ ওরফে রোহিঙ্গা মৌলভী, শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়া; আবদুল হাকিম, শাহপরীর দ্বীপ মাঝেরপাড়া; আতাউল্লাহ, শাহপরীর দ্বীপ দক্ষিণ পাড়া; মৌলভী কলিম উল্লাহ, শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়া। এদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পুলিশের মাঠ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তাও যুক্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় ৬ জুলাই চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অভিবাসন পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে ধরা পড়েন পাঁচ রোহিঙ্গা তরুণ। পরে তাদের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে ফেরত পাঠানো হয়। ১৫ জানুয়ারি বরিশালে পাসপোর্ট করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন চার রোহিঙ্গা। সৌদি আরবে পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট করাতে তাদের কক্সবাজার থেকে বরিশাল নিয়ে যান দালালরা। নড়াইল পাসপোর্ট অফিস থেকে ১০ এপ্রিল এক দালাল ও দুই রোহিঙ্গা নারীকে আটক করে পুলিশ। ৩৫ হাজার টাকায় দালালের মাধ্যমে তারা পাসপোর্ট করতে চেয়েছিলেন। রাজশাহী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে ৪ এপ্রিল এক রোহিঙ্গা তরুণীকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় পাসপোর্ট অফিসের তিন দালালকেও আটক করা হয়। এ ছাড়া দর্শনা, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোহিঙ্গাদের আটক করে কক্সবাজার ক্যাম্পে পাঠানোর একাধিক ঘটনা ঘটেছে।

এ প্রসঙ্গে পাসপোর্ট অ্যান্ড ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আবু নোমান মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, গত বছর ২৫ আগস্ট থেকে নতুন করে অনুপ্রবেশের পর প্রাথমিক অবস্থায় একটি ছোট অংশ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় অনেকে পাসপোর্ট ও জন্মনিবন্ধন সনদ করে থাকলেও বর্তমানে সে পরিস্থিতি নেই। এখন অনেক বেশি সতর্ক রয়েছে প্রশাসন। আবেদনকারীদের ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত ছাড়া এখন পুলিশ কোনো রিপোর্ট দিচ্ছে না।

রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পাসপোর্ট সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের বলেন, ‘প্রথম প্রথম এ ধরনের অনেক অভিযোগ পেয়েছি, কিন্তু এখন আর এমন ঘটনা ঘটছে না।’

এদিকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনকালে রোহিঙ্গাদের আঙ্গুলের ছাপ নেওয়া তথ্যভাণ্ডার এখনো পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অফিসের মূল সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি, তাই অবৈধ উপায়ে পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কবে সেটা যুক্ত হবে, সে সম্পর্কে পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তাদেরই কোনো ধারণা নেই। এ কারণে কোনো রোহিঙ্গা যদি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে থাকেন, তাহলে পুলিশ প্রতিবেদন ছাড়া তাকে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। পাসপোর্ট অধিদফতর সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয়তা সনদ দিয়ে সহায়তা করছেন। এসব ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়াতে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের কেউ রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা সনদ বা জন্মনিবন্ধন সনদ দিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে বলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সুত্র: বাংলাদেশ প্রতিনিদিন

পাঠকের মতামত