প্রকাশিত: ১২/০৮/২০২২ ১১:০১ এএম

কামরুন নাহার চাঁদনী
কক্সবাজারের কাছে বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটা দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্রে আমাদের দেখা হয় রাশিদার সঙ্গে। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী ছিলেন। সবার গায়ে বোরকা ও নিকাব। তবে আমাদের নজর কেড়েছিল রাশিদার চোখের অন্যরকম এক দৃষ্টি।

চন্দনের ফোটাসহ চোখে ভিন্নধর্মী মেকআপ ও সাজানো ভ্রুজোড়া রাশিদাকে আর সবার কাছ থেকে আলাদা করে তুলেছিল। তবে আরও একটি বস্তু রাশিদার স্বাতন্ত্র্য যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল- একটা সুন্দর, চোখ ধাঁধানো সোনালি রংয়ের ছাতা। ছাতার গায়ে আলাদা কাপড় দিয়ে ফুলের কাজ। তবে সঙ্গী নারীদের হাতে ছিল আটপৌরে কালো বা মেরুন রংয়ের ছাতা।

প্রথমে ভেবেছিলাম রাশিদা বোধহয় অন্যদের চেয়ে আর্থিক দিক থেকে বেশি ভালো অবস্থানে আছে। তাই তার ছাতাটি এত চমৎকার কারুকাজ করা। কিন্তু অন্য নারীদের মুখ চেপে হাসা ও টিপ্পনীতে বোঝা গেল রাশিদা সদ্য বিবাহিতা, মাসখানেক হয়েছে তার পরিণয় ঘটেছে। সেজন্যই চোখে ওই সলাজ কটাক্ষ।

বিচিত্র এ ছাতাটির নাম ‘জারা’। নামটি এসেছে জরি শব্দটি থেকে। আর যেকোনো রোহিঙ্গা বিয়েতে কনের সাজের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ এ জারা ছাতা।

‘এখানকার প্রতিটি রোহিঙ্গা নারীর অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে ছাতা,’ বললেন ওই দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা তুহিরাতুন নেসা। ‘এ বস্তু এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, ঘরের কাছে বাথরুমে যেতে হলেও তারা বোরকা পরে, ছাতা সঙ্গে করে নিয়ে যান। এ কারণেই বোধহয় রোহিঙ্গা বিয়ে ছাতা ছাড়া অসম্পূর্ণ,’ বলেন তিনি।

তুহিরাতুনের এ মন্তব্যে সায় দেন রোহিঙ্গা নারীরাও। ওখানে থাকা আরেক তরুণী জানালেন, ‘বাজু, থামি (বিয়ের পোশাক), গহনা, জুতা, ব্যাগ, মেক-আপ, কসমেটিকসের মতো রোহিঙ্গা বরকে কনের বাড়িতে একটি ছাতাও পাঠাতে হয়।’

জারা ছাতা খুঁজতে বের হলাম আমরা। উখিয়া থেকে বালুখালির বলিবাজার- সব রোহিঙ্গা বাজারে চক্কর দিতে শুরু করলাম ছাতাটির সন্ধানে। এদিকে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বলিবাজারের সরু গলিগুলোতে কাদা বাঁচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় একটা কসমেটিকের দোকানে দেখা মিলল আকাঙ্ক্ষিত ওই ছাতার।

দোকানের মালিক ফায়েজ করিম তিন রংয়ের জারা বের করে দেখালেন আমাদের। একটা প্যাস্টেল মিন্ট রংয়ের হালকা সবুজ, আরেকটা ঝাপসা গোলাপি, অন্যটা রাশিদার ছাতার মতো সোনালি। দরকষাকষি করে এ ছাতাগুলো ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে কেনা যাবে।

‘সবার পক্ষে এত দামি ছাতা কেনা সম্ভব নয়। সেজন্য ৫০০, ৬০০’র মধ্যে কিছু ছাতা পাওয়া যায়,’ জানালেন ফায়েজ।

এ ছাতাগুলো চীনে তৈরি করা হয়। তবে সরাসরি চীন থেকে রোহিঙ্গাদের কাছে পৌঁছায় না এগুলো। প্রথমে মায়ানমারে আমদানি করা হয় জারা ছাতা। সেখান থেকে চাটনি, চটিজুতো ইত্যাদি বার্মিজ পণ্যের সঙ্গে এগুলো সীমান্ত হয়ে দেশের রোহিঙ্গা বাজারগুলোতে প্রবেশ করে। বর্তমানে জারা ছাতার জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হলো বার্মিজ ব্র্যান্ড আশাহি।

বাজারে দেখা হলো মো. হারেসের সঙ্গে। রোহিঙ্গা এ যুবক বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন। বোন ও বোন-জামাইয়ের সঙ্গে হারেস বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও তার মা-বাবা মায়ানমারের মংড়ুতেই বাস করছেন।

হারেস জানান, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে ছাতা পর্দার একটি প্রতীক। ‘মায়ানমারেও আমার মা ও বোন যখনই বাইরে বেরোতেন, তাদের সঙ্গে একটি ছাতা থাকত,’ বলেন তিনি।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নারীদের ছাতার ব্যবহার আরও বেশি। এখানে ঘরগুলো খুব কাছাকাছি বলে পর্দার বিশেষ সুযোগ নেই। সেজন্য গোপনীয়তা ও দূরত্ব বজায় রাখতে নারীরা সবসময় ছাতা সঙ্গে রাখেন। এ ছাতা তাদের জন্য হিজাবের মতো কাজ করে।

আমাদের কথা হলো উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা কালচারাল মেমরি সেন্টার (আরসিএমসি)-এর একজন শিল্পীর সঙ্গে। তার কাছ থেকে জানা গেল রোহিঙ্গা বিয়ের ১০টি আচারের কথা। এ আচারগুলোর মধ্যে আছে বিয়ের অনুষ্ঠান, বাগদান, খাবার, সাজসজ্জা, পোশাক, সঙ্গীত, পরিবহণ ইত্যাদি।

‘রোহিঙ্গারা তাদের বিয়েতে পোশাক (থামি ও বাজু), আলখাল্লা, বোরকা, নিকাব ইত্যাদির রং আর ছাতার রং একই রাখে। বর্তমানে ছাতার মতো বোরকাও বিয়ের একটি প্রয়োজনীয় পোশাক হয়ে গিয়েছে। কনে তার বিয়ের পোশাকের ওপর দিয়ে বোরকা গায়ে চড়ায়,’ বলেন ওই শিল্পী। মাঝেমধ্যে কনে সোনালি ফ্রেমের চশমাও পরে। তবে এটা কোনো প্রথা নয়, বরং আধুনিকতারই অংশ।

তিনি আরও জানান, এ ছাতার মূল কাজ পর্দা বা হিজাবের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা। এছাড়া ছাতাটি ব্যবহার করলে মনে করা হয় ওই মেয়ে বা নারী নম্র-ভদ্র আচরণের অধিকারী। ‘কারও ছাতা দেখেই বোঝা যায় তিনি বা তার পরিবারের কেউ সদ্য বিবাহিত কিনা। মেরুন রংয়ের ছাতা হলে বোঝা যায় ওই নারীর বিয়ে অনেক বছর আগে হয়েছে অথবা তিনি অবিবাহিতা।’

নারীদের ছাতা রংচটা হোক বা রঙিন, রোহিঙ্গা পুরুষেরা কালো রঙের ছাতাই ব্যবহার করেন। বিয়েতে কনের কাছ থেকে বরও উপহার পান। এ উপহারের মধ্যে থাকে রঙিন ছককাটা বার্মিজ লুঙ্গি ‘শেরিয়া’, ফতুয়া, টুপি ইত্যাদি। যৌতুকে ব্যাপার থাকলে উপহারের তালিকায় আরও যোগ হয় ঘড়ি, টাকা, মোবাইল ফোন, সোনার গহনা ইত্যাদি।

তবে এসব কিছু নির্ভর করে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপরে।

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ে বিয়ের অন্যান্য রীতি
আরসিএমসি’র কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে মিশে তাদের জীবনের গল্প শোনেন। মায়ানমারে তাদের অতীত জীবন; তাদের খাবার, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আচার ইত্যাদির কথা জানতে চান তারা।

আরসিএমসি’র সেই শিল্পী জানান, ‘এখানে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গারা থাকা-খাওয়ার মতো মৌলিক সুযোগগুলো পেলেও নিজেদের পরিচয়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য হারানোর মানসিক ট্রমা তাদেরকে এখনো তাড়া করে বেড়ায়। আরসিএমসিতে আমরা রোহিঙ্গাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা করে থাকি।’ রোহিঙ্গাদের কৃষি সংস্কৃতি, মাছধরার সংস্কৃতি, নৌকাশিল্প, সুচিকর্ম, বাগান তৈরির শিল্প, খাবারদাবারসহ আরও অনেক সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছে আরসিএমসি।

রোহিঙ্গারা বাগদান বা এংগেজমেন্টকে বলে ‘ফুল তোলাতুলি’ অনুষ্ঠান। এ জনগোষ্ঠীর জীবনে ফুল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ফুল রোহিঙ্গাদের কাছে ভালো, সুন্দর, ও মঙ্গলের প্রতীক।

রোহিঙ্গাদের সাজসজ্জায় কাটা কাগজের নকশা একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে। বিয়ের সংস্কৃতিতেও কাগজের নকশা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রোহিঙ্গা বিয়ের মঞ্চকে তাদের ভাষায় বলা হয় ‘মান দাইং’ যার অর্থ মোড়ানো।

রোহিঙ্গাদের ২৯ ধাঁচের সঙ্গীত আছ। এগুলোর মধ্যে ‘হলনা’ ও ‘কাওয়ালি’ হচ্ছে বিয়ের গান। বিয়ের আগের দিন বরের বাড়িতে ও পরে কনের বাড়িতে গাওয়া হয় এই গানগুলো। Sos : The BUSINESS STANDARD

পাঠকের মতামত