উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৮/০৫/২০২৩ ৫:১২ পিএম , আপডেট: ১৮/০৫/২০২৩ ৫:১৪ পিএম
উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতালের পাশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাঁটাতারের বেড়া কেটে নিজেদের মতো পথ তৈরি করা হয়েছে। রয়েছে এমন শতাধিক পথ। ৩ মে বিকালে তোলা।

রোহিঙ্গাদের চলাফেরার নির্দিষ্ট সীমারেখা রয়েছে কক্সবাজার জেলার উখিয়া- টেকনাফ এলাকার আশ্রয়শিবিরগুলোতে। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে ওই সীমারেখা টেনে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই বেড়া দিয়েও রোহিঙ্গাদের আটকে রাখা যাচ্ছে না। বেড়ার ভেতর ও বাইরে তারা সমানভাবে অবাধে চলাচল করছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজারসহ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গারা ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে কক্সবাজার জেলার যেকোনো অঞ্চলে। জেলায় খুন, মাদক, অপহরণসহ সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এদের একাংশ। এদিকে পুলিশ বলছে, লাখ লাখ মানুষকে তল্লাশি করা সব সময় সম্ভব নয়। তবে স্থানীয়ভাবে কাজ মিললে রোহিঙ্গাদের এই প্রবণতা কমে আসত। তারা ক্যাম্পের বাইরে যেত না।

চেকপোস্টে পুলিশ নেই

গত ২ মে বেলা ৩টার দিকে কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের প্রবেশপথ দিয়ে যাওয়া-আসা করছিল অসংখ্য মানুষ। সেখানে বড় করে ‘পুলিশ চেকপোস্ট’ লেখা সাইনবোর্ড দেখা গেলেও পুলিশ বা এপিবিএনের কোনো সদস্য চোখে পড়েনি। রোহিঙ্গারা কোনোরকম তল্লাশি ছাড়াই অবাধে যাতায়াত করছিল। এমনকি প্রতিটি ক্যাম্পের সামনে দিয়েও অনেক যানবাহন চলাচল করছিল।

শুধু ওইদিন বিকালে নয়, দিন ও রাতের বিভিন্ন সময় গিয়ে দেখা যায় ক্যাম্পের প্রধান ফটক উন্মুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া যেসব গেট রয়েছে, সেগুলো দিয়েও দেখা যায় ইচ্ছেমতো যেকাউকে যাতায়াত করতে। গেটে জিজ্ঞাসা বা তল্লাশি করার জন্য দায়িত্বরত এপিবিএন সদস্যদের কাউকে আশপাশে দেখা যায়নি। উখিয়া ক্যাম্পের দুই-তিনটি গেটে কয়েকজন এপিবিএন সদস্যকে দেখা গেলেও তারা চেয়ারে বসা ছিল। তাদের সামনে দিয়ে চলাচলকারী কাউকে তল্লাশি করতে দেখা যায়নি।

অবশ্য ওইদিন বিকাল ৫টায় টেকনাফের উঠনী পাহাড়ের ওপর পুলিশকে একটি সিএনজি অটোরিকশা থামাতে দেখা যায়। এ সময় যাত্রীরা নিজেদের বাংলাদেশি দাবি করেন। যদিও তাদের কারও সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল না। তারা কক্সবাজার বেড়ানো শেষে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন।

৩ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে কক্সবাজার- টেকনাফ সড়কের উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালী ক্যাম্প এলাকায়ও দেখা যায় একই চিত্র। দেখা যায় রাস্তায় র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির চেকপোস্ট থাকলেও নেই কোনো সদস্য।

কাঁটাতারের বেড়া উধাও শত স্থানে

টেকনাফে এমএসএফ হাসপাতালের সামনের সড়কের দুই পাশ ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। অভিযোগ রয়েছে, অবাধ চলাচলের সুবিধা করে নিতে রোহিঙ্গারা এই ক্যাম্পের চারদিকের কাঁটাতারের বেড়া কেটে ফেলেছে। কেটে ফেলা বেড়ার অংশ দিয়ে চলাফেরা করছে ছোট-বড় সবাই।

একাধিক রোহিঙ্গা জানায়, ক্যাম্পে মাঝেমধ্যে পুলিশ এলেও রোহিঙ্গাদের চলাচলে কখনও বাধা দেওয়া হয় না। যেকোনো প্রয়োজনে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত তারা নিয়মিত অবাধে যাতায়াত করতে পারে।

তবে সম্প্রতি উখিয়া উপজেলা যুবলীগের সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়া ট্রাকভর্তি রোহিঙ্গাদের আটক করে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছিল পুলিশ। এ ছাড়া ফুটবল খেলতে আসা একটি রোহিঙ্গা দলকে উখিয়ার মাঠ থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন উখিয়ার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস।

এপিবিএন ১৪-এর কমান্ডিং অফিসার (পুলিশ সুপার) সৈয়দ হারুণ-উর-রশীদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাঁটাতারের বেড়ার একশ জায়গা কাটা রয়েছে। মানুষকে কাঁটাতার দিয়ে আটকে রাখা যাবে না। তারা কোনো না কোনোভাবে বের হবেই। তিনি জানান, গোয়েন্দা নজরদারিসহ টহল পুলিশ সব সময় সতর্ক হয়ে কাজ করছে। ক্যাম্পের ভেতরেও তল্লাশিসহ একাধিক চেকপোস্টে সব সময় দায়িত্ব পালন করছে।

সড়কে রোহিঙ্গাদের দোকানদারি

লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সামনের সড়কের উভয় পাশে কয়েকশ অস্থায়ী দোকান রয়েছে। দোকানিরা সবাই রোহিঙ্গা। ওই জমির মালিক সড়ক বিভাগ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সড়ক বিভাগের কিছু কর্মকর্তার মাধ্যমে স্থানীয়রা জায়গা দখল করে দোকান তৈরি করে রোহিঙ্গাদের কাছে ভাড়া দিয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গারাও জায়গা দখল করে কয়েকটি দোকান নির্মাণ করেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন অংশ চলে গেছে কয়েকটি রোহিঙ্গাচক্রের দখলে। এসব চক্রের সদস্যসংখ্যা আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ জন। তারা স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কয়েকশ দোকান তুলে ভাড়া দিয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে কুতুপালং বাজারের হেলাল মেম্বার, বালুখালী বাজারের নুরুল আবছার ও আলী আহমদ এবং পালংখালীর গফুর ও মনঞ্জুর। এ ছাড়া হোয়াইক্যং, লেদা, মুচনীর পাশের সড়কের জায়গা দখলে নিয়ে দোকান করতে দিয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা।

গেটের পাশে কথা হয় রোহিঙ্গা আবদুল করিমের সঙ্গে। ক্যাম্পের ভেতরে তার ঘর। তিনি সড়কের পাশে আম ও পান-সুপারি বিক্রি করেন। এসব পণ্য কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে তিনি জানান, টেকনাফ থেকে আনা হয়, কখনও কক্সবাজার গিয়ে নিয়ে আসেন। এ পথে যাতায়াতে কোনো সমস্যা হয় না তার। পাশেই রোহিঙ্গা হামিদুল হক দোকান সাজিয়ে বিক্রি করছিলেন তারকারি ও সবজি। কথায় কথায় জানালেন, ব্যবসা ভালো হচ্ছে।

সড়কের জায়গা দখল করে দোকান নির্মাণ সম্পর্কে সড়ক ও জনপথের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহে আরেফীন জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের কিছু জায়গা আছে সড়কের। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে কোনো জায়গা নেই। কিছু সড়কের পাশে দোকানপাট দখলমুক্ত করা হয়েছে। আরও যেসব জায়গা দখল হয়েছে, তা সড়কের নতুন কাজ শুরু হলে মুক্ত হয়ে যাবে।

উদ্যোগী হতে হবে স্থানীয়দের

শুধু পুলিশ নয়, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের মধ্যে রাখতে হলে স্থানীয়দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। স্থানীয়রা যদি রোহিঙ্গাদের কাজ দিত তাহলে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে যেত না বলে দাবি করেছেন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা। তারা জানান, উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্প কাঁটাতারের বেষ্টনীতে ঘেরা। নিরাপত্তায় নিয়োজিত এপিবিএনের ৮, ১৪ ও ১৬ ব্যাটালিয়ন। ৩৩টি ক্যাম্পের ভেতর ৮ হাজারের বেশি ইজিবাইক (টমটম), ৩ হাজারের বেশি অটোরিকশা চলাচল করে- যার চালকও রোহিঙ্গা। থাকা-খাওয়াসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা ভেতরে থাকার পরও রোহিঙ্গারা বাইরে চলাচল করছে অহরহ।

ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গাদের অবাধে চলাচল প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করে মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে অনেক আগেই কথা উঠেছে। ইদানীং যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে- আমাদের ভূখণ্ডের জন্য রোহিঙ্গারা হুমকিস্বরূপ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থা করছে জাতিসংঘ। তাদের ক্যাম্পের বাইরে আসার প্রয়োজন নেই। যদি চিকিৎসাসহ জরুরি প্রয়োজনে বাইরে আসে, অবশ্যই পুলিশ চেকপোস্টে এন্ট্রি হয়ে আসতে হবে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও উখিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মাহামুদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে চলে যাচ্ছে কক্সবাজার শহরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কক্সবাজার জেলার শতভাগ শ্রমবাজার এখন রোহিঙ্গাদের দখলে। মাছ ধরা, অটো চালানো, ধানক্ষেতের কাজ, দিনমজুরি থেকে শুরু করে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, মাদক পাচারসহ সব কাজেই অংশ নিচ্ছে রোহিঙ্গারা।
সুত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ

পাঠকের মতামত