বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১২/০৮/২০২৫ ১০:৫০ এএম , আপডেট: ১২/০৮/২০২৫ ১:৫৬ পিএম

জমি ক্রয়-বিক্রয়ে কক্সবাজারের ৮১ মৌজার মানুষের উপর এক অবিশ^াস্য খড়গ নেমে এসেছে! এই খড়গটি হলো, জমি ক্রয়ে যুক্ত হলো আকাশচুম্ব উৎসকর! এই সংক্রান্ত সরকারের একটি ভূমি নীতিমালায় কক্সবাজারের এই ৮১ ভূমি মৌজাকে যুক্ত করা হয়েছে। গত ১ জুলাই থেকে এই নীতিমালা কার্যকর করা হয়েছে! এই নীতি কার্যকরের পর থেকে ওই সব মৌজায় জমি ক্রয়-বিক্রয় একেবারের শূন্যের কৌটায় নেমে এসেছে। তাতে ভূমি রেজিস্ট্রিতে বড় ধরণের ধ্বস নেমেছে। ফলে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
জেলা রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ২৪ জুন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। যা কার্যকর হয়েছে গত মাসের ১ জুলাই থেকে। ওই প্রজ্ঞাপন বলা হয়েছে, জমি ক্রয় করলে ক্রেতাকে নাল জমির ক্ষেত্রে প্রতি শতকে ২৫ হাজার, আবাসিক জমি হলে প্রতি শতকে দিতে হচ্ছে ৫০ হাজার এবং বাণিজ্যিক হলে প্রতি শতকে ১ লক্ষ টাকা করে উৎসকর দিতে হবে।
জেলা রেজিষ্ট্রার অফিস সূত্রে আরও জানা যায়, জেলাব্যাপী কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) একটি তালিকা দিয়েছে কক্সবাজার জেলা রেজিস্ট্রারকে। ওই তালিকায় জেলার ১৮৭ মৌজার মধ্যে ৮১ মৌজা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
জেলাব্যাপী আকস্মিক অকল্পনীয় উচ্চ উৎসকর বাড়ানোর কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা। তারা বলেছেন, উৎসকর অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি করায় রেজিস্ট্রেশন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় জমি ক্রয়-বিক্রয় কঠিন হয়ে পড়েছে। এই বাড়তি উৎসকরর কারণে রেজিষ্ট্রেশন ফি বৃদ্ধির ফলে আবাসন খাত এবং জমি বেচাকেনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে এই অস্বাভাবিক উৎসকর কমানো দরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই পরিমাণ উৎসকর শুধু মাত্র সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য প্রযোজ্য। কেননা সিটি করপোরেশন এলাকায় জমির অনেক বেশি। কিন্তু উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হওয়ায় কক্সবাজার জেলাকেও এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে রাজস্ব বোর্ড। সাবেক চেয়ারম্যান লে. কর্ণেল (অব.) ফোরকান আহমদের আমলে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কিন্তু অবিবেচনাপ্রসূতভাবে উন্নয়ন কর্তৃক্ষ ৪০ শতক (এক কানি) ৫ লাখ টাকা দামের জমিও এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে দেন। ৫ লাখ টাকা দামের ওই ৪০ শতক জমিতে এখন উৎসকর দিতে ১০ লাখ টাকা- যা অবিশ^াস্য! কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হটকারী এবং জনবান্ধবহীন এই মনগড়া তালিকার ফলে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

কক্সবাজার সদর সাব-রেজিস্ট্রী অফিসে গিয়ে দেখা যায়, জমি নিবন্ধন কমে গেছে তুলনামূলক হারে। গত ৩ সপ্তাহে দলিল নিবন্ধন হয়েছে তুলনামূলক অনেক কম। কিছু জমি ক্রয়-বিক্রয় হলেও তা বায়নানামা দলিল, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি, পারিবারিক হেবা ঘোষণা দলিল, দান-ঘোষণা দলিল করা হচ্ছে- যা সরকারের রাজস্ব আদায়ের কোন দলিল নয়। সরকারের রাজস্ব আদায়ের একমাত্র দলিল হচ্ছে সাফ কবলা দলিল। যার কারণে দলিল নিবন্ধন ও সরকারি রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে।

দলিল নিবন্ধনে আগ্রহী ঈদগাঁও বোয়ালখালীর ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমি ৫ শতক ধানি জমি কিনেছি ১ লক্ষ টাকা দিয়ে। এই ৫ শতক জমির জন্য রেজিস্ট্রেশন খরচ দিতে হচ্ছে ১ লক্ষ ৩০ হাজার ৫’শ টাকা। এর বাইরে অন্যান্য খরচও রয়েছে। জমির ক্রয়ের চেয়ে নিবন্ধন খরচ বেশি। এই সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের যে আশা ছিল তা প্রতিফলিত হয়নি। সাধারণ মানুষের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই খরচের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করা উচিৎ।’
সুবল দেব নামের আরেক ভুক্তভোগী ব্যক্তি বলেন, ‘মফস্বল এলাকায় উৎসকর ফি বাবদ আগে ছিল ২%  শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি লাখে ২ হাজার টাকা করে। এখন দিতে হচ্ছে প্রতি শতকে ২৫ হাজার টাকা। আমি ১০ শতক জমি নিবন্ধন করার জন্য আসছি। এখানে এসে জানতে পেরেছি আমাকে নাকি শতক প্রতি ২৫ হাজার টাকা করে উৎসকর পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ ১০ শতক জমির জন্য উৎসকর দিতে হবে আড়া লাখ টাকা! এছাড়াও প্রতি লাখে খরচ দিতে হচ্ছে স্ট্যাম্প শুল্ক বাবদ ১.৫%, রেজিঃ ফি বাবদ ১%, স্থানীয় সরকার ফি বাবদ ৩% শতাংশ। ভাবা যায় কোন দেশে বসবাস করছি!’

মহেশখালীর উত্তর নলবিলার বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি একজন শ্রমিক। অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়িতে ৫ শতক জমি ক্রয় করি। বিক্রেতাকে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করে জমি রেজিস্ট্রি করতে গিয়েই জানতে পারি দিতে হবে দেড়লাখ টাকা! কিন্তু আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই রেজিস্ট্রি করতে পারিনি। অন্যদিকে জমি মালিকও আর টাকা ফেরত দিচ্ছে না। এখন আমার পায়ের তলায় মাটি নেই।’

রামুর হাইটুপি এলাকার বাসিন্দা পূর্ণধন বড়ুয়া বলেন, ‘আমি তিন শতক জমি ক্রয় করি ৯ লাখ টাকায়। যাতে আগে উৎসকর আসতো ১৮ হাজার। কিন্তু বাড়তি ফিতে আসবে ৭৫ হাজার। আমি জমির মূল্য শোধ করতে হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে উচ্চ অংকের উৎসকর কেমনে শোধ করবো।’

কক্সবাজার জেলা দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দীন মিজান বলেন, ‘রেজিস্ট্রি ফি বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় অনেকে জমি নিবন্ধন করতে পারছেন না বলে আমাদেরকে বার বার জানাচ্ছেন। আমরাও জনস্বার্থে সংশ্লিষ্ট অফিসের সাথে যোগাযোগ করে এই উচ্চহারে উৎসকর ফি কমানো বা পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোন ধরণের সুফল পায়নি। তাই অনেকে বাধ্য হয়ে সাফ কবলা দলিল নিবন্ধন করতে পারছেন না। আর এতে সরকারও হারাচ্ছে বিপুল রাজস্ব।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা রেজিস্ট্রার রেজাউল করিম বকসী বলেন, ‘এই নীতিমালাটি হওয়ার কারণে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হচ্ছে। সরকার রাজস্ব বাড়ানোর জন্য এটা করলেও উল্টো রাজস্ব বহুগুণ কমে গেছে। যেহেতু এটা সিটি করপোরেশন এলাকায় নয় সেখানে এই ৮১ মৌজার এই উৎসকর নিয়ে সরকারের পুনর্বিবেচনার দরকার রয়েছে। আমরা উর্ধ্বতন মহলকে বিষয়টি জানিয়েছি।’

পাঠকের মতামত

গাজীপুরের সাংবাদিক তুহিন হত্যায় সাংবাদিক ইউনিয়ন কক্সবাজার’র নিন্দা ও প্রতিবাদ

গাজীপুরে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে নির্মমভাবে হত্যার ...

উখিয়া বিএনপির সাবেক যুব বিষয়ক সম্পাদক সাইফুর রহমান সিকদারের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি উখিয়া উপজেলা শাখার সাবেক যুব বিষয়ক সম্পাদক সাইফুর রহমান সিকদার এর আবেদন ...

নাইক্ষ্যংছড়িতে নতুন সদস্য ও নবায়ন কর্মসূচীতে জাবেদ রেজাবিএনপি পরিচয়ে চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজির স্থান নাই

শামীম ইকবাল চৌধুরী, নাইক্ষ্যংছড়ি: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির, নতুন সদস্য সংগ্রহ ও পুরাতনদের ...