প্রকাশিত: ২০/০৮/২০১৮ ৬:৪৯ পিএম , আপডেট: ২০/০৮/২০১৮ ৬:৫১ পিএম

আন্তর্জাতিক ডেস্ক::
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটি অংশ অব্যাহতভাবে ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গারা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছে, বেঁচে থাকার অন্য কোনও অবলম্বন না পেয়েই তারা ইয়াবা পরিবহনের মতো কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। কুতুপালং আশ্রয় শিবিরের থাকা ইয়াবা পরিবহনে জড়িত একজন রোহিঙ্গা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে জানিয়েছে, অর্থের অভাবে ইয়াবা পরিবহন করলেও সে এই কাজ করতে চায় না। সে মিয়ানমারে ফিরতে চায়, যেখানে তার জমি আছে, সম্পদ আছে। সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা ইয়াবা পরিবহনকারীর ভাষ্যে উঠে এসেছে কুতুপালং থেকে কক্সবাজারে ইয়াবা পরিবহনের তথ্য: সে কীভাবে ইয়াবা জুতায় ভরে পাহাড়ি পথ ধরে কক্সবাজার যায়, কোথায় চালান হস্তান্তর করে, কীভাবে আশ্রয় শিবিরের নিরাপত্তা কর্মীদের ফাঁকি দিতে কৌশল অবলম্বন করে ইত্যাদি।
রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির
রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির

যেসব মাদকের কারণে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বাংলাদেশে মহামারির আকার ধারণ করেছে তার কেন্দ্রে এখন রয়েছে ‘মেথ পিল’ নামে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ইয়াবা। থাইল্যান্ডে ‘ক্রেজি মেডিসিন’ আখ্যা পাওয়া ইয়াবা প্রবল আসক্তিমূলক একটি দ্রব্য যা মেথাফেটামিন এবং ক্যাফেইনের সমন্বয়ে বানানো হয়। ট্যাবলেটগুলোতে চকোলেটের মতো রঙ ব্যবহার করা হয়। মিয়ানমার থেকে এসব ইয়াবা বাংলাদেশে পাচার করা হয়। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মিয়ানমারে উৎপাদিত হওয়া এই মাদক পাচার রুখতে হিমশিম খাচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ইয়াবা পরিবহনে ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশ মনে করে মিয়ানমারে অন্তত ৫০টি মাদক উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। কক্সবাজার জেলায় কর্মরত সহকারী পুলিশ কমিশনার সাইফুল হাসান আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা যখন পালিয়ে আশা শুরু করেছিল তখন আমরা তাদের খুব একটা চেক করতাম না। প্রথ দিকে ওই সুবিধা পাওয়ার কারণে বেশ কিছু ইয়াবা বাংলাদেশে ঢুকেছে।’ ইয়াবা পাচারের বিষয়ে কিছু এনজিওর পুলিশকে তথ্য দেওয়ার উদাহরণ থাকলেও সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কতিপয় এনজিওর নাম ব্যবহার করেও অপতৎপরতা চালায়। ইয়াবা পাচারের সূত্রে ৬০০ রোহিঙ্গাকে এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০ থেকে ৫০ পিস ইয়াবার জন্য ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা ৪৬ লাখ। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর জানিয়েছে, ছয় বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৭ গুণ।

কিন্তু কেন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারে জড়িত হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তরে একজন ইয়াবা পাচারকারী আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘আমি বেঁচে থাকার অন্য কোনও পথ না পেয়ে ইয়াবা পাচার করি। আমাকে আমার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এ কাজ করতে হয়। অর্থে অভাবে আমার পক্ষে সৎভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব হচ্ছে না।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ইয়াবা পাচারকারী রোহিঙ্গার পূর্ণ নাম প্রকাশ না করে আল জাজিরা তাকে ‘এ’ হিসেবে সম্বোধন করেছে। এই প্রতিবেদনে তাকে ‘আলতাফ’ ছদ্মনামে সম্বোধন করা হবে।

গত বছর বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ ইয়াবা পাচারের দায়ে ৬৪৯ জনকে গ্রেফতার করেছে যার মধ্যে ১৫ জন মিয়ানমারের নাগরিক। কিন্তু আলতাফ ধরা পড়েনি। ৩৬ বছর বয়সী আলতাফ এক হাজার পিস ইয়াবা কুতুপালং আশ্রয় শিবির থেকে কক্সবাজারে পাচারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পায়। ইয়াবা পাচারে কীভাবে জড়িয়ে পড়েছিল আলতাফ? প্রথম যখন সে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কুতুপালং শিবিরে আশ্রয় নিতে গিয়েছিল তখন সেখানে থাই হয়নি তার ও তার পরিবাররে। তখন সে বাধ্য হয়ে স্থানীয় এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। পরে যখন সে কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে পরিবারসমেত গিয়ে ওঠে, তখন দেখে সেখানে পানি ও থাকার মতো ঘরের প্রচণ্ড সংকট। খাবার অপ্রতুল; দিনে একবেলার মতো হতো। হাতে কোনও অর্থ ছিল না। তাদের যাছে এমন কি বিক্রি করার মতো কিছুও ছিল না।

প্রথমে আলতাফ একটি ছোট দোকান খুলতে চেয়েছিল। কিন্তু কেউ তাকে ঋণ দিতে রাজি না হওয়ায় সে দিকান দিতে পারেনি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে শিবিরে ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত দলটির সঙ্গে দেখা করে সে। সেখানেই আলতাফ জানতে পারে কীভাবে ইয়াবা তৈরি হয়, পাচার হয়, খাওয়া হয় এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ইয়াবার উৎপাদন খরচ খুব কম কিন্তু বিক্রি করে লাভ বেশি।

আলতাফ নিশ্চিত করেছেন, মিয়ানমারের কিছু নাগরিক বিশেষ করে বাংলাভাষী নাগরিক টেকনাফ দিয়ে মিয়ানমারে প্রবেশ করে এবং মিয়ানমার থেকে ইয়াবা নিয়ে আবার বাংলাদেশে ঢোকে। তারপর সেগুলো দেওয়া হয় মাদক পরিবহনকারীদের হাতে। তাদের মাধ্যমে ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলাদেশ জুড়ে। এ বছরের শুরুতে বিষয়টি কেমনভাবে হয় তা দেখার জন্য আলতাফ পাচারকারীদের সঙ্গে রওনা হয়েছিলেন। তার সঙ্গে ২০ জনেরও বেশি পাচারকারী ছিল। আলতাফের ভাষ্য, ‘আমরা জানতাম কোন কোন চৌকিতে পুলিশ তল্লাসি করে। সুতরাং আমরা এক সঙ্গে না গিয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রওনা হয়েছিলাম। কেউ হেঁটে, কেউ মোটরসাইকেলে, কেউ বা বাইসাইকেলে চড়ে মিয়ানমার সীমান্তের দিকে গিয়েছিলাম আমরা। মাইক্রবাস বা অটোরিকশায় করে গেলে নিশ্চিতভাবে তল্লাসি চালানো হতো।’

আলতাফের ভাষ্য, ইয়াবা পরিবহনের যে কাজে সে জড়িত, তা কোনও নিয়মিত কাজ নয়। কখনও সপ্তাহে এক বার কখনও ১৫ দিনে একবার বা কখনও কখনও তার চেয়ে বেশি সময়ে পর পর সে চালান নিয়ে যায়। ব্যবসা চাঙ্গা থাকলে মাসে আত থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে সে। এসব টাকা খরচ হয়ে যায় ঋণ পরিশোধ, মুদি দোকানের বাকি পরিশোধ এবং চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহে খরচ হয়ে যায়।

কুতুপালং আশ্রয় শিবির থেকে কক্সবাজারে কীভাবে ইয়াবা পরিবহন হয় তার বর্ণনা দিয়েছে আলতাফ: প্রথমে পাচারকারীদের কেউ একজন আমার ঘরে বা ক্যম্পের ভেতরের দিকের কোনও এলাকায় ইয়াবার চালান হস্তান্তর করে। কোনও কোনও চালানে ১০০/২০০ পিস ইয়াবা থাকে। কোন কোনও চালানে সর্বোচ্চ এক হাজার পিস ইয়াবাও থাকে। এক হাজার পিসের মতো বড় চালান হলে কখনও জুতার মধ্যে আর কখনও পলিথিনে মুড়িয়ে বেল্টের নিচে করে পরিবহন করি। আর চালান ছোট হলে কাগজে মুড়িয়ে হাতে করেই নিয়ে যাই। হাতে ইয়াবার প্যাকেটটি রেখে তার ওপর মোবাইল ফোন রাখলে কেউ টের পায় না যে অন্য কিছু নিয়ে যাচ্ছি।

ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার চেয়ে ফিরে আসা সহজ। কারণ কুতুপালং শিবিরে সন্ধ্যার পরে শিবির থেকে বের হওয়ার বিষয়ে নিশেধাঙ্গা রয়েছে। সন্ধ্যার পর কাউকে শিবিরের বাইরে যেত দেখলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর ফলে আলতাফের জন্য কাজটি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আলতাফের ভাষ্য, ‘আমি যখন ইয়াবা নিয়ে যাই, তখন মেরিন ড্রাইভের রাস্তা ব্যবহার করি না; পাহাড়ি পথ ধরে যাই। এরপর কক্সবাজার পৌঁছানো খুব সহজ। আমি শুনেছি ইয়াবা পরিবহনকারীদের অনেকে ধরা পড়েছে। কারণ তারা ঠিক মতো বাংলা বলতে পারে না। কিন্তু আমি সবসময়ই বেঁচে গেছি। কক্সবাজার পৌঁছে পূর্বনির্ধারিত স্থানে ইয়াবা হস্তান্তর করি আমি। সাধারণত বিমানবন্দর এলাকার কাছে অবস্থিত বাহারছড়া ও ফিশারি ঘাটে চালানটি বুঝিয়ে দেই।

কাজ শেষে টেকনাফ থেকে বাসে করে সে ফেরত যায় কুতুপালংয়ে। শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা কর্মীদের প্রশ্নের মুখে পড়লে যাতে জাবাব দিতে পারে সেজন্য সে তার সঙ্গে কিছু জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যায়। দেরিতে শিবিরে ফেরা সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আলতাফের ভাষ্য, ‘সঙ্গে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে গেলে আমি বলতে পারি, আমার কিছু জরুরি জিনিসপত্র কেনার দরকার ছিল।’

আল জাজিরা লিখেছে, আশ্রয় শিবিরে চারশ থেকে পাঁচশ ইয়াবা পরিবহনকারী আছে। কিন্তু তারা নিজেরাও নিজেদের সবাইকে চেনা না। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে মাদক ব্যবসায়ীরা এই ব্যবস্থা করেছে। আলতাফের ভাষ্য, ‘আমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত নই। যদি হতাম, তাহলে পুলিশের নজর পড়ত আমাদের ওপর এবং তারা খুব সহজকেই চিহ্নিত করে আমাদের গ্রেফতার করতে পারত।’

নিরাপত্তা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানের বিষয়ে আলতাফের ভাষ্য, ‘আমি বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার বিষয়ে শুনেছি। জেলে যাওয়ার বিষয়েও আমি জানি। ভীতি আমাদের সবার মনেই আছে। কিন্তু আমি কি করতে পারি? আমার যদি টাকা থাকত তাহলে আমি এই কাজ করতাম না।’

মিয়ানমারের ফিরে যেতে ইচ্ছুক আলতাফ বলেছে, ‘প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা হলে আমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। এখানে আমরা আটকে পড়েছি। মিয়ানমারে আমাদের জমি আছে, সম্পদ আছে। আমরা সেখানে কৃষিকাজ করতে পারব। এখানে তো একটা মুরগিও পালন করা যায় না।’

পাঠকের মতামত

গদি নেই তবু সাবেক এমপি বদি!

আবদুর রহমান বদি। কক্সবাজার-৪ আসনের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ছিলেন, তাও আবার ক্ষমতাসীন দলের টিকিটে। মাদক ...

মিয়ানমারে সশস্ত্র লড়াই: আরাকান আর্মির কাছে গুরুত্বহীন রোহিঙ্গারা

মিয়ানমারে জান্তা বাহিনীর নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে নিজেদের জাতিসত্তার স্বীকৃতি আদায় এবং রাখাইন রাজ্যে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ...