প্রকাশিত: ২৮/০৫/২০২২ ৯:৪৩ এএম

ইউক্রেন ও আফগানিস্তানের চলমান পরিস্থিতির কারণে কক্সবাজার জেলায় আশ্রয় নেয় প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাদের সহায়তা তহবিলে সংকটের আশঙ্কা করছেন ইউএনএইচসিআর-এর রোহিঙ্গা বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি। এ আশঙ্কা দূর করার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবশ্য চলমান সহায়তা যাতে না কমে তার জন্য নানা ধরনের তৎপরতা অব্যাহত রাখার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু সহায়তার জন্য নয়, রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোই সমস্যার আসল সমাধান। বাংলাদেশের সেদিকে আরও বেশি জোর দেওয়া দরকার।

রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা

বাংলাদেশে এখন ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা রয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছেন। অল্প কিছু রোহিঙ্গা ভাসানচরে অবস্থান করছেন। জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি) বলছে, চলতি বছর ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের জন্য মোট ৮৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা চেয়েছে। আর ইউএনএইচসিআর-এর সর্বশেষ তথ্য মতে, চলতি বছরে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য এখন পর্যন্ত সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ২৮৫.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সহায়তা পেয়েছে ৩৪.২১ মিলিয়ন ডলার, যা প্রতিশ্রুতির ১২ ভাগ। আর এই গতিতে সহায়তা এলেও শেষ পর্যন্ত ২০০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে। এ পর্যন্ত প্রতিশ্রুত অর্থেও ৮৫ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতি থাকবে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি চাহিদার চেয়ে অনেক কম। এর মধ্যে ভারত থেকেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা আসছেন। পোস্ট কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশেও এখন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। সব মিলিয়ে সর্বশেষ ইউএনএইচসিআর হাইকমিশনার যা বলেছেন তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য মতে, গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর এ পর্যন্ত সেখানকার শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৭ লাখ।

ইউএনএইচসিআর-এর হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বাংলাদেশ সফরে এসে গত ২৫ জুলাই রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল কমে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলে যেসব দেশে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছেন, সেসব দেশকে রোহিঙ্গাদের প্রতি সদয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা কমছে

এখন আফগানিস্তান ও ইউক্রেনের কথা বলা হলেও বাস্তবে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রত্যাশিত আন্তর্জাতিক সহায়তা কখনোই পাওয়া যায়নি।

২০২১ সালে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান-এর যে হিসাব তাতে দেখা যায় ১০ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গাদের জন্য মোট ডোনারদের সহায়তা প্রয়োজন ছিল ৯৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। দিয়েছে ৬৭৪ মিলিয়ন ডলার, যা প্রয়োজনের তুলনায় ২৮ ভাগ কম। ২৬৯ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে প্রয়োজন ছিল ৪৩৪ মিলিয়ন ডলার, পাওয়া গেছে ৩১৭ মিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে ৯৫১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬৫৫ মিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে ৯২০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬৯৯ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে ১০৫৮ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬২৯ মিলিয়ন ডলার।

এখানে স্পষ্ট যে, ২০২০ সালের পর থেকে প্রতিশ্রুত সহায়তাও কমছে এবং প্রতিশ্রুত সহায়তার ৭০ ভাগের বেশি গড়ে কখনোই পাওয়া যাচ্ছে না

বাংলাদেশের করণীয়

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট ইউনিট (রামরু)-র সাবেক চেয়ারপার্সন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো উদ্যোগের গুণগত অগ্রগতি আমরা এখন পর্যন্ত দেখতে পাইনি। তারা নিজেদের স্বার্থই দেখছে। আর এখন নতুন বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা কমে আসছে। এটার জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ পড়ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এর দায় নিতে হবে। তারা দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।’

তিনি মনে করেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য তৎপরতা জোরদার করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে এই সমস্যাটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আমি মনে করি, সহসাই এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাই রোহিঙ্গাদের এখানে কর্মক্ষম করে তুলতে হবে। তাদের শিক্ষিত এবং দক্ষ করার জন্য নতুন নীতি নিতে হবে। শরণার্থী কমিউনিটিকে যুক্ত করে এখন কাজ করতে হবে। তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে যে, তাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তারাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’

আর সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘রোহিঙ্গা বিষয়টি যেন সবাই ভুলে যেতে বসেছেন। এমনকি বাংলাদেশও যেন ভুলে যাচ্ছে। সবাই যেন মনে করছে, রোহিঙ্গাদের থাকার একমাত্র জায়গা বাংলাদেশ। তা না হলে ভারত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশের কোনো উচ্চবাচ্য নেই।’

তার কথা, ‘ইউরোপ এখন ইউক্রেন শরণার্থীদের নিয়ে আছে। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে যে রোহিঙ্গারা এখানে আছে, তা নিয়ে তাদের ভাবনা নেই। বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা যথেষ্ট বলে আমি মনে করি না। রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান। তার কোনোই অগ্রগতি নেই। আর বাংলাদেশ কত চাপ নেবে? বাংলাদেশকে এখন সর্বোচ্চ জোর দিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো উচিত। মিয়ানমারের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিকভাবে আরও বেশি যোগাযোগ বাড়াতে হবে।’

সরকার যা করছে

বাংলাদেশের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন’ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে এখন ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অবস্থান করছেন। তিনি সেখান থেকে টেলিফোনে জানান, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য যে সহায়তা দেয়া হচ্ছে, তা যেন অব্যাহত থাকে তা নিয়ে আমরা এখন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি। বালিতে জাতিসংঘের ডেপুটি সেক্রেটারি, সাধারণ পরিষদের সভাপতি, ইউএনডিআরআর-এর প্রতিনিধির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য বলেছি। তারা বলেছেন, যে সহায়তা দেয়া হচ্ছে তা অব্যাহত থাকবে।’

তিনি ইউএনএইচসিআর-এর রোহিঙ্গা বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডির সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে বলে জানান। ফিলিপ্পো গ্রান্ডি প্রতিমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা যাতে না কমে সেজন্য তারা অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সবাইকে বলছি, বোঝানোর চেষ্টা করছি যে বাংলাদেশ একটি ছোট্ট দেশ। আমরা এলডিসি থেকে গ্রাজুয়েশন করে মাত্র ডেভেলপিং কান্ট্রিতে যাচ্ছি, তাই রোহিঙ্গাদের সহায়তা কমে গেলে আমাদের জন্য অসুবিধা হবে। আমরা চাপে পড়বো। সবাই আমাদের আশ্বস্ত করছেন।’

এদিকে শুক্রবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ভারত থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ভারতে ফেরত পাঠানোর কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। রোহিঙ্গারা যখন যে রাষ্ট্রে থাকবে, সেখানেই থাকবে। আমরা মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। অন্যান্য রাষ্ট্রও তা করবে। ইতোমধ্যে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে বলে দেওয়া হয়েছে, ভারত থেকে কোনো রোহিঙ্গা প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের যেন ফেরত পাঠানো হয়।

পাঠকের মতামত

ইরানের ভয়ে তটস্থ ইসরায়েল!

ইসরায়েলে বড় ধরনের ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন হামলা আসন্ন বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ...