সবাইকে নিয়ে সুখে থাকার আশায় ও পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য শত শত নারী শ্রমিক পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবে। তবে এখানে আসার পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না পাওয়ার পাশাপাশি গৃহকর্তাদের নির্যাতনের মুখে কাজ ছেড়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নিচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে আসা শত শত প্রবাসী নারী শ্রমিক।
সৌদি আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস ও জেদ্দা কনস্যুলেটে গত রোববার পর্যন্ত প্রায় ৩২৯ জন নারী শ্রমিক আশ্রয় নিয়েছেন। তবে প্রতিদিন বাড়ছে তাঁদের সংখ্যা। এর আগে গত ২৯ মার্চ থেকে এক মাসে দূতাবাসে আশ্রয় নেওয়া ৫০২ জন নারী শ্রমিককে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানান সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের শ্রম কাউন্সিলর সারোয়ার আলম।
নতুন করে আশ্রয়ে থাকা ৩২৯ নারীর মধ্যে জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে রয়েছেন ৭৪ জন, বাকি আড়াই শতাধিক রয়েছেন রিয়াদ দূতাবাসে। এসব নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বৈধভাবে শ্রমিক হিসেবে এলেও বাংলাদেশ থেকে দালালরা যে কাজের কথা তাঁদের বলেছিল, সৌদি আরব এসে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাঁদের সেই কাজ দেওয়া হয়নি।
রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নেওয়া কয়েকজন নারী বলছেন, তাঁদের কাউকে কাউকে হাসপাতালে নার্সের সহযোগী ও পিয়নের কাজের কথা বলা হলেও সেখানে যাওয়ার পর দেওয়া হয়েছে ক্লিনারের কাজ। আশ্রয় নেওয়া অধিকাংশই মূলত গৃহশ্রমিক। তাঁরা ঠিকমতো বেতন পেতেন না। তিন বেলা ঠিকমতো খাবারও পেতেন না। এ ছাড়া দিনে দিনে শারীরিক নির্যাতন বাড়তে থাকার পাশাপাশি যৌন নির্যাতনেরও ঘটনা ঘটে। এ কারণে তাঁরা পালিয়ে দূতাবাসের সেফ হোমে আশ্রয় নিয়েছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান কয়েকজন নারী শ্রমিক।
রিয়াদ দূতাবাসে আশ্রয় নেওয়া এক নারী শ্রমিক বলেন, দেশ থেকে তাঁকে হাসপাতালে নার্সের সহযোগী হিসেবে কাজের কথা বলা হয়েছিল। তাঁকে সেই কাজ না দিয়ে দেওয়া হয়েছে বাসার ক্লিনারের কাজ। প্রতিশ্রুত কাজ না পাওয়ার সঙ্গে তাঁর ওপর যোগ হয় শারীরিক নির্যাতন। এসব সহ্য করতে না পেরে তিন সপ্তাহ আগে ওই বাসা থেকে পালিয়ে রিয়াদের দূতাবাসে আশ্রয় নেন।
তিন সপ্তাহ দূতাবাসের আশ্রয়কেন্দ্রে কাটিয়ে দেওয়া এই নারীর মতো অনেকে আরো বেশি সময় ধরে রয়েছেন। কবে দেশে ফিরতে পারবেন তাও জানেন না।
এদিকে দেশে ফেরার আশায় প্রতিদিনই আশ্রয়কেন্দ্রে নতুন নতুন নারী শ্রমিক আসায় বর্তমানে রিয়াদ দূতাবাস ও জেদ্দার মিশন, দুই স্থানেই আশ্রয়কেন্দ্রে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত নারী শ্রমিক রয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই থাকা-খাওয়ার সমস্যায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের শ্রম কাউন্সিল বিভাগের কর্মকর্তা আবু জারা জানান, জেদ্দার আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৫ জনের ধারণক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু বর্তমানে রয়েছে ৭৪ জন। এদের মধ্যে ৩৪ জনকে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাকি ৪০ জন নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের হেফাজত থেকে পালিয়ে আসায় তাঁদের দেশে পাঠানো সহজ হচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো শ্রমিক পালিয়ে গেলে বা নিখোঁজ/হারিয়ে গেলে ওই শ্রমিকের হেফাজতকারী কর্তৃপক্ষ বা মালিককে বিষয়টি সৌদি সরকারকে অবহিত করতে হয়। এ বিষয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম শেষ না করে শ্রমিককে দেশে ফেরত পাঠানো সময়সাধ্য ব্যাপার।
ওই ৪০ নারী শ্রমিককে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আবু জারা বলেন, ‘আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। উত্তরের অপেক্ষায় আছি।’
বর্তমানে আশ্রয় নেওয়া নারী শ্রমিকদের কবে নাগাদ দেশে পাঠানো যাবে- এমন প্রশ্নে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বলেন, ‘শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠানো একটি চলমান প্রক্রিয়া। সাধারণত কোনো শ্রমিক আমাদের কাছে আসার পর দুই থেকে আট সপ্তাহ সময় লাগে। এর মধ্যে আমরা সব প্রক্রিয়া শেষ করে তাঁদের ফেরত পাঠিয়ে দিই।’
শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত সহযোগিতাপরায়ণ মন্তব্য করে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘নিয়মিতই শ্রমিকরা দূতাবাসে আশ্রয় নিচ্ছেন। তাঁদের দেশে ফেরতও পাঠানো হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝির কারণে শ্রমিকরা চুক্তি ভঙ্গ করে কাজ ছেড়ে দেন। তারপরও তাঁদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ আমাদের সহযোগিতা করে।’
পাঠকের মতামত