
এ নদীর মোহনা ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটননগরী কক্সবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য। অথচ সেই নদী এখন দখল-দূষণে সংকুচিত হয়ে সরু খালে রূপ নিচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্থানীয়দের আশা ছিল, বাঁকখালী নদী দখলমুক্ত হবে।
তবে দখলবাজদের চোখ রাঙানিতে বাঁকখালী এখনও যেন বাকরুদ্ধ!
দখলদাররা নদীতীর ভরাট করে, প্যারাবন কেটে পাকা স্থাপনা তুলেছেন।
গণঅভ্যুত্থানের পর কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার এলাকায় দখলবাজরাই সর্বেসর্বা।
কস্তুরাঘাট এলাকায় সম্প্রতি উচ্ছেদ করা খালি জায়গায় নতুন করে স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। এরই মধ্যে কয়েকটি জায়গায় টিনের ঘেরাও দেওয়া হয়েছে।
নদী উদ্ধারে আদালতের নির্দেশে প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছিল। তবে রাজনৈতিক মহলের চাপ ও দখলদারদের প্রতিরোধের মুখে অভিযান আটকে যায়।
৫ সেপ্টেম্বর সকালে উচ্ছেদ শুরুর পরপরই দখলদাররা দুই ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করেন।
আগের চার দিনে ৬৩ একর নদীর জমি উদ্ধার করা গেলেও সড়ক অবরোধের পর আর অভিযান চালানো যায়নি।
নদীর জমি দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণে পুরোভাগে রয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা।
উচ্ছেদ অভিযানের মুখে তারা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। তাদের চাপেই প্রশাসন অভিযান বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড় থেকে নেমে আসা বাঁকখালী নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৭ কিলোমিটার। এই নদীর তীরে এক দশক আগে লাগানো হয়েছিল প্যারাবন।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো সামুদ্রিক দুর্যোগ থেকে উপকূল রক্ষায় সেখানে ছিল বাইন ও কেওড়ার সবুজ দেয়াল। তবে সেই বন-নদীই এখন দখল-দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার বাঁকখালীর নুনিয়ারছড়া, মাঝিরঘাট ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীর বুকজুড়ে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা।
কোথাও নদী ভরাট করে ছোট ছোট প্লট বানানো হয়েছে, আবার কোথাও টিনের ঘেরা, পোলট্রি খামার, দোকানপাট, চাল-ময়দার কারখানা কিংবা বসতঘর।
দখলদাররা নদী ও প্যারাবনের জমি নিজেদের বলে চালিয়ে দেদার বেচাকেনা করছেন। একেকটি প্লট ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারি জমি বেচে কোটি কোটি টাকা পকেটে ভরছেন তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে উজাড় করা হয়েছে বাঁকখালী তীরের লক্ষাধিক বাইন ও কেওড়াগাছ।
ধ্বংস করা হয়েছে অন্তত ২০০ প্রজাতির পাখির আবাসস্থল। এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ একর প্যারাবন নিশ্চিহ্ন করে নদীর জমি দখল করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, দখলদারদের খোলস ভাঙতে বড় ভূমিকা রেখেছে শহরের কস্তুরাঘাট এলাকায় নির্মিত নতুন সেতু ও সড়ক। ৫৯৫ মিটার দৈর্ঘ্যের দৃষ্টিনন্দন সেতু ও সড়ক নির্মাণের পর নদীতীরের জমি দখল এবং প্লট বিক্রির হিড়িক পড়ে।
এসব জমি হাতবদল করতে ব্যবহার হচ্ছে ভুয়া কাগজপত্র। ২০১৩ সালে বাঁকখালীর তীরে পৌর বর্জ্য ফেলা শুরু হয়। আর তাতেই প্রভাবশালীরা দখলের মওকা পেয়ে যায়। নদী ভরাট হয়ে গেলে দখলদাররা টিনের ঘেরা দিয়ে জায়গা ভাগ করে নেয়।
গুজব ছড়ান নেতারা
হাইকোর্টের নির্দেশে বাঁকখালী নদী দখলমুক্ত করতে ১ সেপ্টেম্বর থেকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএর নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়।
চার দিনে ৬৩ একর জমি উদ্ধার ও ৪৯৬টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও ৫ সেপ্টেম্বরের পর অভিযান আর এগোয়নি। গুজব ছড়িয়ে রাজনৈতিক নেতারা পরিকল্পিতভাবে মানুষকে সড়ক অবরোধে নামান।
গত ২৪ আগস্ট দখলদারদের তালিকা করে চার মাসের মধ্যে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সেই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতেই অভিযান শুরু হয়েছিল।
তবে ৫ সেপ্টেম্বর সকালে যৌথ বাহিনী উচ্ছেদে গেলে দখলদাররা এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়– প্রশাসন নাকি বৈধ ঘরবাড়িও গুঁড়িয়ে দেবে। খবর ছড়িয়ে পড়তেই আশপাশের কয়েকশ নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে আসেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাশেদুল হক রাশেদ অভিযান বন্ধ করতে বিপুল পরিমাণ টাকা জোগান দিয়ে পরিকল্পিতভাবে লোক জড়ো করেছিলেন বলে স্থানীয়রা জানান।
এ সময় জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনির উদ্দিন ১০ থেকে ১৫ জন নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে অভিযানে বাধা দেন। মুহূর্তেই বিমানবন্দর সড়কসহ শহরের ঝাউতলা থেকে লালদীঘিরপার পর্যন্ত দুই কিলোমিটার এলাকা অবরোধ করেন কয়েকশ বিক্ষোভকারী।
বিআইডব্লিউটিএর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াকিল বলেন, মনিরের নেতৃত্বে শুরুতে বাধা দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর কয়েকশ লোক নেমে আসে।
তবে মনির উদ্দিন বলেন, নথিপত্র না দেখে অভিযান চালাচ্ছে প্রশাসন। তাই আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম। আওয়ামী লীগ নেতা মাশেদুল হক রাশেদের মোবাইল নম্বরে ফোন দেওয়া হলে তিনি ধরেননি।
অবরোধ চলাকালে কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবীবিষয়ক সম্পাদক লুৎফর রহমান ঘটনাস্থলে গিয়ে বক্তব্য দেন।
তিনি বলেন, হঠাৎ উচ্ছেদে কয়েকশ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ছেন, জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। তাই আমরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছি।
রাজনৈতিক নেতারাই দখলবাজের তালিকায়
স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি অফিস এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) প্রায় ৩০০ দখলদারের আলাদা তালিকা তৈরি করেছে।
ভূমি অফিস প্রভাবশালী কারও নাম তালিকাভুক্ত না করলেও বিআইডব্লিউটিএর তালিকায় উঠে এসেছে প্রভাবশালী দখলদারের নাম।
এর মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, কক্সবাজার পৌর বিএনপির সভাপতি রফিকুল হুদা চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাশেদুল হক রাশেদ ও তাঁর ভাই জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সহসভাপতি শাহিনুল হক মার্শাল।
এ ছাড়া এবি পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কাশেমের নামও আছে নদী দখলদারের তালিকায়।
বাঁকখালী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নুনিয়ারছড়ার ৬ নম্বর জেটি ঘাটে নামতেই ডান পাশে মাশেদুল হক রাশেদ নদীর জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন ১০ তলা ভবন। এর দক্ষিণ পাশে গড়ে তুলেছেন বরফের মিল। ১০ তলা ভবনের পাশে তাঁর ভাই শাহিনুল হক মার্শাল গড়ে তুলেছেন চারতলা ভবন।
এর উত্তর পাশে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আব্দুর রহিম গড়ে তুলেছেন বসতবাড়ি।
পাশে জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি আয়েশা সিরাজ নির্মাণ করেছেন বসতি। এর পাশে জেলা কৃষক দলের সভাপতি গিয়াস উদ্দিন আফসেল নির্মাণ করেছেন বসতবাড়ি।
এর দক্ষিণে নতুন বাহারছড়া এলাকায় কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান তুলেছেন বহুতল ভবন ও টিনশেট সেমিপাকা বাসা।
খাদ্যগুদামের পাশে কক্সবাজার পৌর বিএনপির সভাপতি রফিকুল হুদা চৌধুরী করেছেন মাছের খামার।
পেশকারপাড়া এলাকায় কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে নদীর জমি দখল এবং জলাশয় ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন আকারের প্লট। তার পাশেই দখল করেছেন মোহাম্মদ আলম নামের স্থানীয় এক বিএনপি নেতা। প্লট আকারে এখন তা বিক্রি করা হচ্ছে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কাশেম নদীর জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন ডকইয়ার্ড। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তাঁর মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
বাঁকখালী নদী দখলের অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তর তিন বছরে চারটি মামলা করেছে।
মামলায় উল্লেখযোগ্য আসামির মধ্যে রয়েছেন– কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনান, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য ইসতিয়াক আহমেদ জয়, ছাত্রলীগ নেতা তায়েফ আহমেদ, জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আমীর আলী ও যুবদল নেতা আব্দুল মালেক ইমন।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন বলেন, বাঁকখালী নদী দখলের অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে করা সব মামলার প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে এজাহারভুক্ত কোনো আসামিকে বাদ দেওয়া হয়নি। বরং তদন্ত করতে গিয়ে আরও যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা বাঁকখালী নদী দখলমুক্ত করতে গেলাম। হঠাৎ আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। পাঁচ দিনের অভিযান তিন দিনে শেষ করতে হলো।
সেখানে কারও ১০ তলা ভবন ভাঙা পড়বে, কারও চারতলা ভবন ভাঙা হবে বলে মাঠ পর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হলো। দেখবেন, যখন আমরা উচ্ছেদ বন্ধ করলাম, তখন কারা খুশি হলো? খোঁজটা নেবেন। তার মানে এই নয়, বাঁকখালী নদীর উচ্ছেদ থেমে গেছে। আমরা উচ্ছেদ করব, আবারও অভিযান শুরু হবে।
সূত্র : সমকাল

পাঠকের মতামত