প্রকাশিত: ১২/০৯/২০১৭ ৬:৪৮ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১:৪১ পিএম

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেয়া এলাকাগুলোতে ত্রাণের জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে। আরাকান সড়কের পাশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা গাড়ি দেখলেই ছুটে আসছে। খাদ্য, বস্ত্র পাওয়ার জন্য যারপরনাই চেষ্টা করে চলেছেন তারা। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে যেসব ত্রাণ যাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। অনেক চেষ্টা করে একজন পাচ্ছেন, অন্যজন ব্যর্থ মনোরথে খালি হাতে ফিরছেন। তিনি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছেন। গত কয়েক দিন ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালি, থাইংখালি ও পালংখালী এলাকায়। সরকারের তরফে অবশ্য বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের এমন ত্রাণ তৎপরতায় উপকারের চেয়ে বিশৃঙ্খলাই বেশি হচ্ছে। ত্রাণ কার্যক্রমকে একটি সমন্বয়ের মধ্যে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বলা হয়েছে, এখন থেকে বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দেয়া ত্রাণ সরাসরি বিতরণের সুযোগ না দিয়ে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে জমা নেয়া হবে। সরকারি ত্রাণ তহবিলে জমা পড়া এসব ত্রাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে উখিয়া, টেকনাফসহ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বিতরণ করা হবে। প্রশাসনের যুক্তি হচ্ছে এতে ত্রাণ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে আরাকান সড়কে যে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে তা নিরসন হবে। একই সঙ্গে ক্যাম্প এবং রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে থাকা রোহিঙ্গারা সমানভাবে ত্রাণ পাবেন। তাছাড়া সরকার যেসব এলাকায় রোহিঙ্গাদের নিতে চাইছে তারা সেখানে যেতেও বাধ্য হবে। অবশ্য এ নিয়ে ভিন্ন বক্তব্যও আছে। স্থানীয়রা বলছে, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ নিয়ে বরাবরই রাজনীতি হয়। তা-ও নির্দয় রাজনীতি। সব সরকারের আমলেই এটা হয়েছে। সেখানে বিরোধী বিএনপি-জামায়াত আগে থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তারা তাদের স্থানীয় কর্মীদের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ-সহায়তা দিয়ে কাছে রাখার চেষ্টা করে। সরকার এবার সেই ‘রাজনীতি’র পথ বন্ধ করতে চায়। তাছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফেও এ নিয়ে জোরালো সুপারিশ রয়েছে। সেগুনবাগিচা চায় প্রয়োজনের নিরিখে রোহিঙ্গা এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা। এটি যেন এমন না হয় যে ত্রাণ ও সুযোগ- সুবিধার খবরে বাকি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চলে আসে! কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন গতকাল মানবজমিনকে বলেন, ত্রাণ বণ্টনের ক্ষেত্রে সমন্বয় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন থেকে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আর ত্রাণ দিতে পারবে না। এটি জেলা প্রশাসনের দপ্তরে (ত্রাণ ভাণ্ডারে) জমা হবে। সেখান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে বিতরণ করা হবে। গতকাল ত্রাণবাহী অনেক গাড়ি উখিয়া ও টেকনাফে ঢুকতে দেয়া হয়নি জানিয়ে এসপি বলেন, প্রায় ১৫-১৬টি গাড়ি আমরা ফেরত পাঠিয়েছি। আমরা তাদের বলেছি জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দিতে। তারা তা দিয়েছেন কি-না তা আমার জানা নেই। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা এসব ত্রাণ ফিরিয়ে না দিয়ে তাৎক্ষণিক পুলিশ প্রটেকশনে বণ্টনের ব্যবস্থা করার কোনো চিন্তা আছে কি-না এমন প্রশ্নে এসপি বলেন- না, এটি করা যাবে না। কারণ এক গাড়ি, দুই গাড়ি ত্রাণে কিছুই হয় না। এতে বিশৃঙ্খলা বেশি হয়। সেখানে লাখ লাখ লোক। কাকে দেবেন আর কাকে দেবেন না? তাই আমরা মনে করি এটি সরকারি ভাণ্ডারে জমা দিলে সুশৃঙ্খলভাবে প্রত্যেক রোহিঙ্গার কাছে এটি সম-বণ্টনের ব্যবস্থা করা হবে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেই বণ্টন হবে। সরকারি ভাণ্ডারে ত্রাণ জমা দিতে লোকজনকে উৎসাহিত করতে ওই প্রতিবেদকসহ গণমাধ্যমের ভূমিকাও আশা করেন তিনি। এদিকে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও ত্রাণ সমন্বয় করার সিদ্ধান্তের কথা জানান। তবে গতকাল ত্রাণবাহী যে সব গাড়ি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে সেই তথ্য তার জানা নেই বলে দাবি করেন। বলেন, ত্রাণ সমন্বয়ে সরকারি নির্দেশনা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। যারাই ত্রাণ নিয়ে উখিয়ায় পৌঁছাতে পেরেছেন তাদেরকে আমরা ত্রাণ বিতরণের স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। তারা আমাদের নির্ধারিত জায়গার বাইরে যাননি। এতে আমরা অনেক বেশি রোহিঙ্গাকে ত্রাণ সহায়তার আওতায় নিতে আসতে পেরেছি। আগে একজন বারবার পেতো, অন্যজন একেবারেই কোনো কিছু পেতো না। সমন্বয়ের কারণে সেটি অনেকটাই কভার করা গেছে। এ নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক গতকাল মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে বলেন, ত্রাণ বণ্টনের ক্ষেত্রে আমরা ডিসির কাছে দেয়ার কথা বলেছি। উল্লেখ্য, রাখাইনের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে মংডুতে মিয়ানমার সৈন্যদের নৃশংসতা এখনো থামেনি। সেখান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, এখনো বর্মী বাহিনী গ্রামে গ্রামে যাচ্ছে। তারা লুটপাট চালাচ্ছে। গত দুইদিনেও বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য ঘরবাড়ি পোড়ানো হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
নবাগত রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন শুরু: এদিকে নবাগত রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন করেছে সরকার। সোমবার দুপুর দুইটার দিকে উখিয়ার বালুখালীস্থ অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রম শুরু হয়। নিবন্ধন সেলের প্রধান কর্নেল শফিউল আজম জানান, নিবন্ধনের সময় ১০ আঙুলের ছাপ ও ছবি নেয়া হবে। তাদের মিয়ানমারের ঠিকানা, নাম, পিতা-মাতার নামসহ নানা বিষয়ে তথ্য নেয়া হবে। তথ্য সেলের সদস্য জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লুৎফুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, বিজিবি, জেলা প্রশাসন, পাসপোর্ট অফিস এবং আইওএম যৌথভাবে তথ্য সেলে কাজ করছে। কোনো রোহিঙ্গা যাতে তালিকা থেকে বাদ না পড়ে, সেই লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে কাজ করবে এই তথ্য সেল।
এদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার অফিসের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শিনজো কুবো জানিয়েছেন, শরণার্থী বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশনার জর্জ অকোথ-উবু তিনদিনের সফরে আজ ঢাকা আসছেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশনার কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন। এরপর শুক্রবার তিনি রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনার জন্য থাইল্যান্ড যাবেন। যেখানে জাতিসংঘের মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। ঢাকাস্থ ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধি এ নিয়ে বলেন, ‘আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হচ্ছে, যেসব রোহিঙ্গা আসছে তাদের খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’ জাতিসংঘের পক্ষ থেকে শনিবার প্রাথমিকভাবে ৭৭ মিলিয়ন ডলার সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এটি পরে আরো বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সুচিকে চিঠি দালাইলামার: শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সুচিকে চিঠি লিখেছেন তিব্বতের নির্বাসিত আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামা। বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার ঘটনায় দালাইলামা উদ্বেগও জানিয়েছেন। চলমান রোহিঙ্গা সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করতে দেশটির স্টেট কাউন্সেলরের প্রতি চিঠিতে আহ্বান জানান দালাইলামা। চিঠিতে সুচি ও তার সহযোগী নেতাদের শান্তি ও সংহতির চেতনায় দেশটির জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজের সব অংশের মানুষের কাছে যেতে আবেদন জানান তিনি। চিঠি লেখার আগে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান সহিংসতার ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন দালাইলামা। তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর হামলাকারীদের গৌতম বুদ্ধের পথ অনুসরণের আহ্বান জানান। বলেন, মহামতী গৌতম বুদ্ধ অবশ্যই মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের সহায় হবেন। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সরকারি বাহিনী ও কট্টরপন্থি বেসামরিক বৌদ্ধরা সহিংস দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। তাদের নৃশংসতার মুখে রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা এরই মধ্যে ৩ লাখ ছাড়িয়েছে। এখানে আগে থেকে প্রায় ৪ লাখ মিয়ানমার নাগরিক রয়েছেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি সম্প্রতি এক ফেসবুক স্ট্যাট্যাসে এ সংখ্যা ৭ লাখ ছাড়িয়েছে বলে উল্লেখ করেন। রাখাইনেও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর চলমান অপারেশনকে এথনিক ক্লিনজিনিং বা জাতিগতভাবে নির্মূলের এক টেক্সটবুক বা পাঠ্যপুস্তক বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ। সুত্র মানবজমিন

পাঠকের মতামত

দুই রোহিঙ্গা জাতীয় পরিচয়পত্র বানাতে ভৈরবে এসে আটক

জাতীয় পরিচয়পত্র বানাতে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে এসেছিলেন দুজন রোহিঙ্গা। ...

মিয়ানমারের আরেক গুরুত্বপূর্ণ শহর বিদ্রোহীদের দখলে

মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা দেশটির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের দখল নিয়েছে। মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী তা’আং ...

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও দূরপাল্লার ট্রেন পটিয়া স্টেশনে যাত্রা বিরতির দাবি

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ও দূরপাল্লার ট্রেন পটিয়া স্টেশনে যাত্রা বিরতিসহ বিভিন্ন দাবিতে রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমকে স্মারকলিপি দিয়েছেন ...