
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটের দুই বছর উপলক্ষে ট্রাম্প প্রশাসনকে এমন তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ)।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে দলে দলে বাংলাদেশে ছুটে এসেছিল রোহিঙ্গারা। দুই বছরেও সমাধান হয়নি এ সংকটের। এমন পরিস্থিতিতে ইউএসসিআইআরএফ-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বার্মায় ওই ভয়াবহ ঘটনার দুই বছর পর যুক্তরাষ্ট্র এখনও ‘খুব সামান্যই’ করছে এবং তা-ও ‘অনেক বিলম্বিত’।
ইতোমধ্যেই ট্রাম্প প্রশাসন বার্মার ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সেগুলোকেও স্বাগত জানিয়েছে ইউএসসিআইআরএফ। সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটির ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সঙ্গে যে ভয়াবহ কাজ করেছে তার তুলনায় দায়ীদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করাটাই যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ নয় বলে প্রতীয়মান হয়। দায়ী সামরিক কর্মকর্তা এবং অন্য পক্ষগুলোকে অবশ্যই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো সিদ্ধান্তের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে হবে।
মিয়ানমারে ভয়াবহ রোহিঙ্গা নিপীড়নকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে ঘোষণা দিতেও ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউএসসিআইআরএফ।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় চার মার্কিন আইনপ্রণেতা সোমবার এক বিবৃতিতে এমন একটি আইনের প্রস্তাব করেছেন, যাতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্মম সহিংসতার জন্য মিয়ানমার সরকারকে নতুন নিষেধাজ্ঞার চাপে ফেলা যায়। একইসঙ্গে দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে ট্রাম্প প্রশাসনকে আরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এ আহ্বান জানানো ব্যক্তিরা হচ্ছেন হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান এবং ডেমোক্র্যাট নেতা ইলিয়ট এনজেল, রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা স্টিভ চ্যাবোট, ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর বেনিয়ামিন এল কার্ডিন, রিপাবলিকান সিনেটর টড ইয়াং। তারা মূলত রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনায় বার্মিজ সরকারে থাকা সামরিক বাহিনীর অংশটির ওপর জোরালো নিষেধাজ্ঞার তাগিদ দিয়েছেন। মার্কিন সিনেটে নিজেদের সহকর্মীদের প্রতি তাদের আহ্বান, ঊর্ধতন বার্মিজ সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অর্থবহ নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য ইতোমধ্যেই প্রতিনিধি পরিষদ কর্তৃক গৃহীত আইনটির ভাষা যেন পরিবর্তন করা না হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, আমাদের বিশ্বাস সেখানে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেটি গণহত্যার মতো অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্য এখনও অর্থবহ জবাবদিহিতা রয়েছে।
মার্কিন আইনপ্রণেতারা বলেন, আজ বার্মিজ সামরিক বাহিনী দেশটির অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদেরও সন্ত্রস্ত করে তুলছে। কয়েক দশক ধরে এটা অব্যাহত রয়েছে। এই নৃশংসতার বিচার হওয়া উচিত।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো যথাযথ শব্দচয়নের জন্যও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও-এর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
তারা বলেন, প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছে তা স্বীকার করাটাও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কিছুটা ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
এর আগে গত ২৪ আগস্ট এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানায়, তারা অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরদার করে বর্মী সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ। মিয়ানমারের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার হরণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা তদন্তে গঠিত জাতিসংঘের এক অনুসন্ধানী দল জানায়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নারীরা ধারাবাহিকভাবে বর্মী সেনাবাহিনীর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ঘটনা তদন্তে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে গিয়ে সেইসব ভয়াবহ যৌন নিপীড়নেরা ঘটনা সম্পর্কে জানতে সক্ষম হয় ওই তদন্ত দল।
রোহিঙ্গা নিধনের দুই বছরপূর্তিতে দেওয়া বিবৃতিতে পররাষ্ট্র দফতর সংশ্লিষ্ট সবাইকে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে রাজনৈতিক সংলাপে বসে মানবিক সহায়তা সরবরাহের আহ্বান জানানো হয়। দফতরের মুখপাত্র মর্গান অর্তেগাস বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর দায়বদ্ধতার অভাব এবং তাদের ওপর বেসামরিক নজরদারির এখতিয়ার না থাকায় এখনও রাখাইনে নিপীড়ন চলছে, একই ঘটনা কাচিন, শান কিংবা মিয়ানমারের অন্যান্য রাজ্যেও।’
সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করে যুক্তরাষ্ট্র জানায়, অন্যান্যদেরও বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো উচিত। ২০১৭ সালের সহিংসতা পর এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ৫৪ কোটি ২০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
অর্তেগাস বলেন, ‘মিয়ানমারকে শক্তি, শান্তিপূর্ণ ও উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে বিচার ও দায়বদ্ধতা অপরিহার্য। আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের পরিবেশ নিশ্চিতের আহ্বান জানাই।’
সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার উদ্দেশ্যে অভিযান চালানো হয়েছিলো। এখনও রাখাইনে তাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, তারা কফি আনান নেতৃত্বধীন কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। এটাই রাখাইন রাজ্য এবং সেখান থেকে যারা পালিয়ে গেছে তাদের জন্য সেরা পথ।
পাঠকের মতামত