
উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি::
মিয়ানমার সীমান্তে নো ম্যান্স ল্যান্ডে স্থল মাইন বিস্ফোরণে আরো ৪ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। গতকাল সোমবার সকালে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে এপারে আসার সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পোতা মাইন বিস্ফোরণে এরা নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ ও মাইন বিস্ফোরণে নিহত অনেক রোহিঙ্গার লাশ বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে থাকতে দেখেছে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা।
জানা গেছে ১২ বছর আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থানরত উখিয়ার চাকবৈঠা গ্রামের আব্দুল মাজেদের ছেলে গুরা মিয়াসহ তার ভাই আলি আহমদ ও একই গ্রামের নুরুল আলম, আবুল হোসেন রোববার সকালে সীমান্ত এলাকা থেকে গরু কিনতে গেলে ওয়ালিডং চাল বেপারির ঢালা ৪১ নং পিলার এলাকায় এই মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সোমবার সকাল ৭ টায় গুরা মিয়ার আত্নীয়–স্বজনরা নিহতের লাশ উদ্ধার করে। দুপুর ১টায় নামাজে জানাযা শেষে তার লাশ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তার বড় ভাই আলী আহমদ জানান, আমার ভাইয়ের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসার সময় সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে বিভিন্ন স্থানে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
ওদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের চাকঢালার বড়ছন খোলা ও আশার তলীর ৪ পয়েন্টে পৃথক সময়ে আরো ৪টি মাইন বিস্ফোরিত হয়। এতে ১ রোহিঙ্গা নিহত হয়। আর ৩টি মহিষ আহত হয়েছে। মিয়ানমার সীমানার নো ম্যানস ল্যান্ড এ সব ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, গতকাল সোমবার সকাল ১১ টায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কয়েকজন নিজেদের ফেলে আসা ৩ টি মহিষ নিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের ৪৪ নম্বর পিলারের কাছাকাছি নো ম্যানস ল্যান্ডে পৌঁছলে ৩টি স্থল মাইন বিস্ফোরিত হয়। মিয়ানমার বাহিনীর পুঁেত রাখা এ মাইন বিস্ফোরণের শব্দে তখন পুরো এলাকা কেঁপে উঠে। আর রাত ৭টা থেতে ৯ টার মধ্যে সীমান্তের ৪৫, ৪৬ ও ৪৭ নম্বর পিলার এলাকায় পৃথকভাবে আরো ৩টি স্থল মাইন বিস্ফোরণ হয়। রাত ১১ টায় ৪৫ নং পিলারের কাছে মাইন বিস্ফোরণে নিহত হন পেংছড়ি গ্রামের বাসিন্দা মোক্তার আহমদ(৪৫)। পরিবারসহ বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে তার দুটি পা উড়ে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে একের পর এক মাইন বিস্ফোরণে স্থানীয় লোকজন আতংকিত হয়ে পড়ে । প্রথম মাইন বিস্ফোরণে যে রোহিঙ্গা কৃষক নিহত হয় তার নাম ছৈয়দ আহমদ (৫৫)। তার বাড়ি মিয়ানমারের টাইর ঢেবা।
এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়িস্থ ৩১ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ারুল আজিম জানান,সীমান্তের ৪৪ নম্বর পিলারের মিয়ানমারের অভ্যন্তরে মাইন বিস্ফোরণে কয়েকটি মহিষ হতাহত হওয়ার কথা তিনি শুনেছেন। তবে যেহেতু ঘটনাটি মিয়ানমার অভ্যন্তরে সুতরাং এ দেশের বিজিবি’র সেখানে গিয়ে কোন কিছু করার সুযোগ নেই। তিনি এও জানান, সীমান্তের মিয়ানমার বাহিনী নো ম্যানস র্যান্ডের কাছাকাছি অসংখ্য স্থল মাইন বসিয়েছে। যাতে করে লোকজনের পাশাপাশি অগণিত বন্য প্রাণী হতাহত হচ্ছে । উল্লেখ্য,এর আগের কয়েকদিনে এ ধরণের মাইন বিস্ফোরণে নারী সহ ৪ জন রোহিঙ্গা নিহত হন। আর আহত হন আরো ৪ জন।
অন্যদিকে রোববার রাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার পথে ৩৯–৪০ নং সীমান্ত পিলারের মাঝামাঝি নো ম্যান্স ল্যান্ডে রাখাইনে মংডু কোয়ারবিল এলাকার বদি আলমের ছেলে নুরুল ইসলাম (২৫) মাইন বিস্ফোরণে নিহত হন। তার লাশ রোববার রাতে তার পিতা এসে কুতুপালং শরনার্থী শিবিরে নিয়ে গেছে বলে বিজিবি ক্যাম্পের সুবেদার জসিম উদ্দিন জানান। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী পুরো সীমান্ত এলাকা জুড়ে মাইন পুঁতে রেখেছে বলে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন।
মিয়ানমার সরকার অস্বীকার করলেও দুই দেশের যৌথ সীমান্তে মিয়ানমার স্থলমাইন পুঁতে রাখছে বলে দেশটির সরকারের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ইতোমধ্যে করেছে বাংলাদেশ সরকার। অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, গত সপ্তাহে সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের একটি গ্রামে আরও চারটি বিস্ফোরণে একজন নিহত এবং দুই কিশোর আহত হয়। গত ৩ সেপ্টেম্বর বিস্ফোরণে পঞ্চাশোর্ধ এক নারীর পায়ের জখম পরীক্ষা করে মানবাধিকার সংগঠনটি জানায়, ক্ষতের ধরন থেকে চিকিৎসকরা বলেছেন, এটা বিস্ফোরক কোনো কিছুর কারণেই ঘটেছে, যা শক্তিশালী ও ভূমি থেকে উপরের দিকে বিস্ফোরিত হয়েছে। যা ভূমি মাইনের কারণে হয়ে থাকে। অ্যামনেস্টির অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ, এসব ঘটনায় ব্যবহার করা অন্তত একটি মাইন পিএমএন–১ স্থলমাইন বলে চিহ্নিত হয়েছে, যা সাধারণত জখম করার জন্যই তৈরি করা হয়।
এদিকে বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ স্থল মাইন মিয়ানমার সরকার ব্যবহার করছে বলে সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দাবি করার পর তার সমর্থন মিলল পালিয়ে আসা আহত রোহিঙ্গাদের কথায়। তারা বলছেন পেছনে গুলি–আগুন, সামনে সীমান্তে মাইন। সেনাবাহিনীর গুলিতে ও মাইন বিস্ফোরেণে আহত অনেক রোহিঙ্গা এখন চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চমেক পুলিশ ফাঁড়ির তথ্য মতে, মিয়ানমার থেকে আসা গুলি, বোমা, মাইনের আঘাতসহ অসুস্থ অবস্থায় সোমবার পর্যন্ত মোট ৯৩ জন রোহিঙ্গা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে মারা গেছেন দুই জন। সুস্থ হয়ে চলে গেছেন ১১ জন এবং কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন একজন। বাকি ৭৯ জন চিকিৎসাধীন। সুত্র আজাদী
পাঠকের মতামত