প্রকাশিত: ০৭/১০/২০১৭ ৭:১৬ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১২:৩৬ পিএম

রাজীব নূর ও আবদুর রহমান, টেকনাফ থেকে ::
‘রিফুজির জীবন মওতের তুন এককানা বালা’- কেমন আছেন প্রশ্নের উত্তরে নিজ ভাষায় এই কথাটি বললেন মংডুর কাওয়ারবিল গ্রাম থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আসা আলী জোহার। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘শরণার্থীর জীবন মৃতু্যর চেয়ে একটু ভালো।’
আলী জোহার এবং তার সঙ্গী জাহিদ হোসেনের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে। এক মাস আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর টেকনাফ থেকে কক্সবাজারের দিকে যেতে ১৬ কিলোমিটার দূরের এই ক্যাম্পের সামনে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের যে ঢল দেখা গিয়েছিল, গতকাল ৬ অক্টোবর সে তুলনায় কোনো ভিড়ই নেই। লেদা ক্যাম্পে যাওয়ার আগেই নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের বিপরীত দিকে টেকনাফ রোডের একেবারে গা ঘেঁষে দেখা গেল সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে ত্রাণ বিতরণ। পাশেই আছে রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। শরণার্থী আসার ঢলে একটু ভাটা পড়লেও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে রোহিঙ্গাদের আসা একেবারে থেমে যায়নি। লেদা ও নয়াপাড়ার রোহিঙ্গা শিবির দুটি নতুন আসা রোহিঙ্গাদের জন্য নয়। তবু নানান আত্মীয়তার সূত্রে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই। বেশিরভাগই উখিয়ার বালুখালীতে গভীর অনিশ্চয়তায় জীবনযাপন করছে। আলী জোহার ও জাহিদ হোসেন অন্যদের তুলনায় ভাগ্যবান। আলীর ১২ জনের পরিবারের সবাই আছে লেদায়। জাহিদের বাবা কুতুপালং, মা হ্নীলার আলীখালীতে। জাহিদ স্ত্রী ও পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে আছেন লেদায়। আলী এসেছেন মংডুর কাওয়ারবিল থেকে এবং জাহিদ এসেছেন একই এলাকার নলবুনিয়া থেকে।

দুই গ্রামেই প্রবল নির্যাতন-নিপীড়ন হয়েছে বলে শোনালেন তারা। পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পেরে এবং আশ্রয় পাওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা অপরিসীম। আলী জোহার বললেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাপের কাজ করেছে। তবু অসন্তোষের কারণ জানতে চাইলে জাহিদ বলেন, ২০ দিন আগে টেকনাফে এসে প্রথম ক’দিন যেখানে ছিলেন সেখানে পুকুরের পানি খেতে হয়েছে। পেশাব-পায়খানা \হকরার জায়গা ছিল না। আলী জোহারের অসন্তোষ এত ছোট বিষয়-আশয় নয়, তিনি নিজেকে জিন্দা লাশের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, শরণার্থীর বেঁচে থাকা আসলে মরে বেঁচে থাকার মতো। তার দুঃসহ জীবনের কথা শুনতে শুনতে মনে হলো মাত্র ক’দিন আগে শরণার্থী বিষয়ে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের লেখারই প্রতিধ্বনি।
পরে লেদা থেকে আরও অন্তত ২০ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং ঘুরে হোটেলে ফেরার পর খুঁজে বের করি হাসান আজিজুল হকের ওই লেখাটি, যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমি নিজে, বাংলা যখন ভাগ হয়, তখন, এই শরণার্থীর প্রবল ঢল ধেয়ে আসতে দেখেছি। একসময় তার সঙ্গে যুক্তও হয়ে গেলাম। ধারণা করি, মানুষের শেষ পরিণতি মৃতু্য; কিন্তু তার পরই যদি অস্তিত্বের চূড়ান্ত সংকট বলে কিছু থাকে, তাহলে তা এ-ই : শরণার্থী হয়ে যাওয়া। মৃতু্য আর শরণার্থীদশা- একেবারে পরস্পরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। শরণার্থীর জীবন হয়তো মৃতু্যর মুখ থেকে ফিরে আসার সান্ত্বনায় খানিক স্থিতি পায়, কিন্তু সেই জীবনের অগ্রগতি আর হয় কই।’

তবে সবার মধ্যে এমন মনোবেদনা নেই, বরং বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থীই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। পায়ে গুলিবিদ্ধ হাজেরা বেগম, থেংখালীর ত্রাণ বিতরণের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন ক্রাচে ভর দিয়ে। তবে শেষ পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি তার। গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে তিনি সেখানে আসার পরপরই দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাসদস্যরা হাজেরার হাতে ত্রাণ তুলে দিলেন। কিন্তু শিশুদের অবস্থা সত্যিই খারাপ। তারা কিছুই বুঝতে পারছে না, বলতেও পারছে না। তবু একটু খাবার পাওয়ার জন্য শিশুদের লাইনে দাঁড়াতে দেখা গেল থেংখালীতেই। ভাতের সঙ্গে গরুর মাংস ও আলু দিয়ে হালিমের মতো একটা খাবার পেয়ে খুশি শিশুরা। এ রকমই এক শিশু মোহাম্মদ আমিনের সঙ্গে আলাপ হলো টেকনাফ রোডের কেরনতলীতে। গতকালই বছর দশেকের এই শিশুটি এসেছে এপারে। সে অবশ্য নিজের বয়স কত তা-ই ঠিকঠাক করে জানাতে পারেনি। আমিন জানাল, তাদের গ্রামের নাম হাসসুরাতা। তার বাবা আমির হোসেন, মা দিলুনি। মা-বাবা, ভাইবোন কোথায় হারিয়ে গেছে কিছুই জানা নেই আমিনের। পুথিন পাহাড়ে মৌলভি নুর আহমদ জানালেন, এরকম আরও অনেক শিশু আছে, যারা তাদের মা-বাবার কী পরিণতি হয়েছে, তা জানে না। রাইম্ম্যাবিল গ্রামের মৌলভি নুর আহমদের তিনতলা সেগুন কাঠের বাড়ি ছিল। চোখের সামনে দেখেছেন সেই বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সহায়-সল্ফপত্তি ফেলে তিনি প্রাণে বাঁচতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি দেন অনিশ্চিত যাত্রায়। এখন শরাণার্থী হয়ে হোয়াইক্যংয়ের পুথিন পাহাড়ের চূড়ায় কষ্টের জীবন কাটাচ্ছেন। তিনি বলেন, এটা কি জীবন, জীবন না। খাওয়ার উপযোগী একটু পানি সংগ্রহ করতে হলে দিতে হয় লম্বা লাইন। আমার যে বাচ্চারা না চাইতে অনেক কিছু পেয়ে যেত, তাদের নিয়ে পলিথিনের তাঁবু টাঙ্গিয়ে কাদামাটিতে থাকছি। একটুখানি বৃষ্টি হলে তাঁবুতে পানি ঢোকে।

আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতে বেশ বৃষ্টি হয়েছিল। শুক্রবার সকালটায় রোদে কাদামাটি শুকিয়ে এলেও দুপুরের দিকে আবার একটু একটু বৃষ্টি শুরু হয়, বিকেলে বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে শরণার্থীদের দুর্ভোগও। টেকনাফ ও উখিয়া মিলে রোহিঙ্গাদের ১০টির মতো শরণার্থী শিবির রয়েছে। এগুলোর মধ্যে টেকনাফের লেদা ও নয়াপাড়ার দুটি এবং উখিয়ার কুতুপালংয়ের দুটি পুরনো ক্যাল্ফপ। এ ছাড়া উখিয়ার বালুখালীতে গত বছর অক্টোবরে রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করার পর নতুন করে একটি রোহিঙ্গা বস্তি গড়ে উঠেছিল, সেটি এবার অনেক বিস্তৃত হয়ে বালুখালী-১ ও বালুখালী-২ নামে পরিচিতি পেয়েছে। গত এক মাসে উখিয়ার থেংখালি, কুতুপালং টিভি টাওয়ার কেন্দ্র, জামতলী, হাকিমপাড়া এবং টেকনাফের পুথিনের পাহাড়ে শরণার্থীদের নতুন বস্তি গড়ে উঠেছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের সবাইকে শেষ পর্যন্ত বালুখালীতেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে ওই শিবিরে লাখ তিনেক রোহিঙ্গাকে নিয়ে আসা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ কমেছে কি-না জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আরও বলেন, একটু কমেছে। তবে এখনও দিন-রাত, সব সময়ই রোহিঙ্গারা আসছে। প্রশাসন কাউকে বাধা দিচ্ছে- এমনও না, আবার কাউকে স্বাগত জানাচ্ছে তা-ও নয়।

তবে উখিয়া ও টেকনাফের পথে যেতে যেতে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তারা বলছেন, টেকনাফ ও উখিয়ার মাত্র এক মাস আগের দৃশ্যের সঙ্গে এখনকার দৃশ্যের মিল নেই। বিস্তর পাহাড় কাটা পড়েছে। উজাড় হয়েছে বনভূমি। তাই স্থানীয়রা চান, থামুক রোহিঙ্গাদের আসার ঢল। এদিকে ইন্টার সেক্টর কো অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসজি) হিসাব অনুযায়ী, দু’দিন পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে স্থানীয়দের দাবি, বাস্তব সংখ্যা সাত লাখেরও বেশি হবে। নতুন-পুরনো মিলিয়ে টেকনাফ ও উখিয়ায় এখন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছে। সুত্র: সমকাল

পাঠকের মতামত

শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে পোস্ট, এসিল্যান্ড প্রত্যাহার

শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সিরাজুম মুনিরা ...

আলোচিত স্কুলছাত্রী টেকনাফের তাসফিয়া হত্যা: এবার তদন্ত করবে পুলিশ

চট্টগ্রামের আলোচিত স্কুলছাত্রী তাসফিয়া আমিন হত্যা মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের ...