উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৫/১০/২০২৫ ১১:০৫ এএম

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি। দীর্ঘ সময় ধরে এখানকার রাজনীতিতে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তির নাম শফি উল্লাহ। বিগত সরকার আমলে ছিলেন আওয়ামী লীগ উপজেলা সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান। ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকারি অর্থ লুট, ভূমি দখল, অর্থ পাচার, রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্টতার মতো বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তার গায়ে কাঁটার আঁচড় লাগেনি। কিছুদিন পালিয়ে থাকলেও এখন প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন। এরই মধ্যে খোলস পালটে রোহিঙ্গা নেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। তার এই নতুন রূপ সীমান্ত নিরাপত্তার জন্যও বড় ধরনের হুমকি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

জানা যায়, শফি উল্লাহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিজের উপস্থিতি জোরালো করেছেন। সম্প্রতি উখিয়ার একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নিজেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থাপন করেন। সেখানে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমার পিতা সালেহ আহমদ ছিলেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা এবং রোহিঙ্গা অধিকার আন্দোলনের নেতা।’ অর্থাৎ রোহিঙ্গা পরিচয়কে সামনে এনে নিজেকে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন তিনি।

জানা যায়, আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রক্ষা করে আসছেন শফি উল্লাহ। নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফ অঞ্চলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, অবৈধ নাগরিকত্ব প্রদান, জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি এবং মানব পাচারের মতো কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসবের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়েছেন তিনি।

বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ক্যশৈহ্লার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন এই শফি উল্লাহ। স্থানীয়দের দাবি-শফি উল্লাহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প, জমি বরাদ্দ এবং দরপত্র নিয়ন্ত্রণে ক্যশৈহ্লার ছায়াতলে থেকে সুবিধা ভোগ করতেন। দুজনের এই জোট একসময় বান্দরবানের রাজনীতি ও প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করত।

শুধু তাই নয়, শফি উল্লাহর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার আরেক উৎস ছিল তৎকালীন মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং-এর স্ত্রী। তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন শফি উল্লাহ। এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তিনি অনেক প্রশাসনিক সহায়তা ও দলীয় আশীর্বাদ পেয়েছেন। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পেরেছেন।

এ মুহূর্তে শফি উল্লাহ নিজেকে রোহিঙ্গা রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। রোহিঙ্গারাও তাকে নিজেদের লোক বলে মনে করে। এজন্যই রোহিঙ্গাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান তিনি।

স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে শফি উল্লাহ নতুন কৌশল নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি রোহিঙ্গাদের সহানুভূতি কুড়াতে চাইছেন, পাশাপাশি সীমান্ত অঞ্চলে মাদকের প্রবাহ, মানব পাচার ও ভোটার তালিকা জালিয়াতিতে নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখছেন। এটি দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নাইক্ষ্যংছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় শফি উল্লাহ ও তার পরিবারের নামে বিপুল জমি, বিলাসবহুল রিসোর্ট, একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। শুধু সোনাইছড়িতেই খাস জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন রিসোর্ট। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, ভূমি দখল ও নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। সোনাইছড়ি জুমখোলা এলাকায় নিজের বাগানে যেতে সরকারি ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা খরচ করে একটি রাস্তা নির্মাণ করছেন। প্রকল্পটি স্থানীয়দের বিস্ময় ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সরকারের অর্থে তৈরি এই রাস্তা জনসাধারণের উপকারে আসছে না।

শফি উল্লাহর বিরুদ্ধে সরকারি পুকুর দখল করে ভরাট, পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণ, বনভূমি দখল ও প্রকল্পের অর্থ লুটের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় একাধিক মামলা হলেও কোনোটিরই কার্যকর বিচার হয়নি।

২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের হোটেল লর্ডস থেকে ডিবি পুলিশ এক পাকিস্তানি নাগরিকসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। অভিযোগ ছিল, তারা ‘আরএসও’ নামক রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনের নেতা এবং শফি উল্লাহর নেতৃত্বে গোপনে বৈঠক করছিল। তখন গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে আসে, শফি উল্লাহ বিদেশি ফান্ড সংগ্রহে, মিয়ানমারভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তায় এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রাজনৈতিক সংগঠন বিস্তারে সক্রিয় ভূমিকা রাখছিলেন। পরে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও রাজনৈতিক প্রভাবে তিনি জামিনে ছাড়া পান।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শফি উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে আসা এসব অভিযোগ সঠিক নয়। স্থানীয় কিছু লোক ষড়যন্ত্র করে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করছে। সুত্র, যুগান্তর

পাঠকের মতামত