ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার থেকে::
পাড়া – মহল্লা শহর ও নগর বিস্তিৃতির পর এবার দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশ যাচ্ছে ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা। সীমান্ত জনপদ টেকনাফ -কক্সবাজার ও রাজধানীসহ দেশজুড়ে মরণঘাতক এই মাদকটির শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। আর এই সিন্ডিকেটের ফলে সারাদেশে ইয়াবা এখন সহজলভ্য নেশা। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে যত্রতত্র।
জানা গেছে, দেশজুড়ে এই সিন্ডিকেটে রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির অসাধু সদস্যও জড়িয়ে পড়ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর, জেলা-উপজেলা, এমনকি গ্রামেও বিস্তার লাভ করেছে মরণনেশা ইয়াবা। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষিত লোকজনও ঝুঁকছে ইয়াবা সেবনে। অল্প সময়ে বড়লোক হওয়ার নেশায় জড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা ব্যবসায়ও। সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় অন্যান্য মাদকের চেয়ে ইয়াবার কদর এখন সবচেয়ে বেশি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, শত চেষ্টাতেও ইয়াবা চালানের রুটটি বন্ধ করা যাচ্ছে না। মিয়ানমার থেকে চট্টগ্রাম ও কঙ্বাজারকেন্দ্রিক রুটেই দেশে আসে ইয়াবা। গত এক বছরে এলিট ফোর্স র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন, বিজিবি ও পুলিশ প্রায় দশ কোটি পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে। যার মধ্যে প্রায় ৫ কোটি পিস উদ্ধার করা হয়েছে কেবল চট্টগ্রাম-কঙ্বাজার এলাকা থেকে। এছাড়া পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সদস্যরা নিয়মিত ইয়াবা উদ্ধার করছে।
চলতি বছরের ২০ জুন রাতে ফেনীর লালপুল এলাকা থেকে ৬ লাখ ৮০ হাজার ইয়াবাসহ র্যাবের হাতে ধরা পড়েন কক্সবাজার জেলা পুলিশের হোয়াাক্যং ও রামু থানায় কর্মরত সাবেক এ এস আই মাহফুজুর রহমান। কঙ্বাজার ও চট্টগ্রাম হয়ে ইয়াবা পাচারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। যার প্রমাণ, গতবছরের জানুয়ারি মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে পাঠানো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি প্রতিবেদন। যেখানে ইয়াবা পাচারকারীদের একটি তালিকায় রয়েছে ৭ পুলিশ সদস্যের নামও।
গোয়েন্দা পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সূত্র জানিয়েছে, ইয়াবার সব বড়চালান মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে বিভিন্নভাবে দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ব্যবসার সঙ্গে বিভিন্ন নামিদামি পেশার মানুষ জড়িত। যাদের সন্দেহের বাইরে রাখা হয়, তারাই এই ব্যবসায় জড়িত। সন্দেহের বাইরে রাখার কারণেই সুযোগটা গ্রহণ করেন তারা।
গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর মাইক্রোবাসে করে কঙ্বাজার থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথে পথে ৪০ হাজার ইয়াবাসহ বেসরকারি টেলিভিশনের এক সাংবাদিক দম্পতিকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। আটক ঐ সাংবাদিকের নাম মো. সেলিম। তার স্ত্রীর নাম খালেদা বেগম। তিনি বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের কঙ্বাজার জেলা প্রতিনিধি ছিলেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম মেট্রো উপ-অঞ্চলের পরিদর্শক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, আমাদের কাছে খবর ছিল, কঙ্বাজার থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে ইয়াবা পাচার হচ্ছে। তবে তাদের পরিচয় জানা ছিল না। ফিরিঙ্গিবাজারে মাইক্রোবাস থামিয়ে তল্লাশির সময় আটক দম্পতির সিটের পাশে রাখা কম্বলের ভেতর থেকে ৪০ হাজার ৫০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। মো. সেলিমকে কঙ্বাজার বেসরকারি টেলিভিশন সাংবাদিকদের সংগঠন ‘ইলেকট্রনিক মিডিয়া জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন’ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি ঐ সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এর আগে গত বছরের ২৭ জুলাই কঙ্বাজারে ২৩ হাজার পিস ইয়াবাসহ মো. সাদ্দাম নামে এক পুলিশ কনস্টেবলকে আটক করে পুলিশ। বিভিন্ন সময় উদ্ধারকৃত ইয়াবা ধ্বংস করার কথা বলে বাইরে নিয়ে তিনি তা জমা করতেন। ব্যবসা করতেন। এই ঘটনায় কঙ্বাজার সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক সহকারী অধ্যাপক বলেন, ইয়াবায় মানসিক ক্ষতি বেশি হয়। এছাড়া অপরাধে জড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা থাকে। কারণ এগুলোর অনেক দাম। এর অর্থ জোগাতে আসক্তরা অপরাধে জড়াতে পারেন। নিয়মিত আসক্তদের মাঝে সন্দেহপ্রবণতার সৃষ্টি হয়। তারা পাশের ও কাছের মানুষকে সন্দেহ করতে শুরু করেন। ইয়াবা আসক্তির কারণে একজন মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। এ রকম চলতে থাকলে আমাদের তরুণ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। এর ক্ষতির দিক নিয়ে আমাদের আরও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে বলেও জানান তিনি।
পাঠকের মতামত