চিকিৎসার জন্য ভিসা পেতে তিন সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামে ভারতীয় ভিসা সেন্টারে যাওয়া-আসা করছেন নগরের কোতোয়ালী এলাকার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন। কিন’ ভিসার দেখা পেলেন না তিনি। প্রতিদিন ভোর চারটা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়েও ভিসা সেন্টারের ভেতরে ঢোকার সুযোগ পাননি তিনি। গতকাল সোমবার দুপুর ১২টায় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার।
‘কয়েকদিন ধরে ই টোকেনের জন্য সার্ভারে ঢোকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। গোপন খবর পেয়ে কোতোয়ালী এলাকায় গিয়ে একটি দোকান থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় ই টোকেন সংগ্রহ করেছি’, বললেন আগ্রাবাদের বাসিন্দা ফরিদ আলম।
শুধু দেলোয়ার ও ফরিদ আলম নয়, চিকিৎসা, ভ্রমণ ও ব্যবসায়িক কাজের জন্য ভারতের ভিসা পেতে ভারতীয় ভিসা সেন্টারে চরম ভোগান্তিতে পোহাচ্ছেন ভিসা প্রত্যাশীরা। সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের কারণে সিরিয়াল পেতে তিন-চারদিন আগে লাইন দাঁড়িয়েও ভিসা কেন্দ্রে ঢুকতে পারছেন না অনেকে। এমনকি রাত কাটাতে হচ্ছে ভিসা কেন্দ্রের পাশে ফুটপাতেই।
অভিযোগ আছে, সিরিয়াল দেয়া, ই টোকেন সংগ্রহ কিংবা ভিসা পাইয়ে দেয়ার নামে একজন প্রত্যাশীর কাছ থেকে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র। এ চক্রের সাথে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে।
বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির নির্বাহী সদস্য সৌমেন্দ্র বড়-য়ার অভিযোগ, ভারতে বৌদ্ধদের বড় ধর্মীয় উৎসবে যেতে গত ১৫ অক্টোবর প্রায় ৫০০ জনের ভিসা ইস্যুর জন্য চট্টগ্রামে ভারতীয় ভিসা সেন্টারে আবেদন করেন তারা।
এর মধ্যে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা শুদ্ধানন্দ মহাথেরা ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা পি আর বড়-য়ার মাধ্যমে দেন দরবার করে ২৩০ জনের
গ্রুপ ভিসা ইস্যু করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। কিন’ ভিসার কাগজপত্র পেতে তারা পড়ে যান বিড়ম্বনায়। আর এ বিড়ম্বনার কারণ হলো ‘টাকা’।
সৌমেন্দ্র বড়-য়া অভিযোগ করে বলেন, ‘বিশ্বপ্রতাপ বড়-য়া ও টিটু বড়-য়া নামে আমাদের দলের দুই সদস্য ভারতীয় ভিসা সেন্টারের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশ করে ভিসা প্রত্যাশী প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা করে দাবি করে। পরে টাকা পয়সা খরচ করে ভিসার কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হয়েছে।’ ভিসা সংগ্রহ করতে গিয়ে এর আগে তিনি কখনো এভাবে হয়রানির শিকার হননি বলে জানান সৌমেন্দ্র।
পরিচয় গোপন রেখে একাধিক ভুক্তভোগী জানান, হয়রানির বড় কারণ ভিসার জন্য অনলাইনের মাধ্যমে ই-টোকেন সংগ্রহ করা। অনেকে নিজের কম্পিউটার থেকে সার্ভারে ঢুকে ই-টোকেন সংগ্রহ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন। দালাল চক্র ওয়েবসাইট জ্যাম করে ভিসা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে ফায়দা লুটছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ভারতীয় ভিসা সেন্টারে চলছে টাকার খেলা। এক সপ্তাহের মধ্যে ভিসা ডেলিভারি পেতে চাইলে প্রত্যাশীকে গুনতে হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকা। ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের এক কর্মকর্তার সাথে দালাল চক্রের যোগসাজশ আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, যারা টাকা দিচ্ছেন তাদের ফাইলে সাংকেতিক হিসেবে ‘ছোট স্বাক্ষর’ ব্যবহার করেন ওই কর্মকর্তা। আর একদিনে ভিসা পেতে চাইলে প্রত্যাশীকে ঘুষ হিসেবে দিতে হচ্ছে ৯ হাজার টাকা। আর একদিনের মধ্যে ভিসা প্রাপ্তির ফাইলে ওই কর্মকর্তা ব্যবহার করছেন ‘বড় স্বাক্ষর’।
খুলশি থানার ওসি নিজাম উদ্দিন গতকাল সোমবার সুপ্রভাতকে বলেন, ‘মাঝে মধ্যে ভারতীয় ভিসার ই টোকেন সংগ্রহের ওয়েবসাইটটি হ্যাক হয়ে যায়। শুনেছি ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন অফিসের কিছু লোকজন ভিসা ইস্যু নিয়ে এদিক-সেদিক করছে। তবে আমরা দালাল চক্রকে দৌড়ের মধ্যে রেখেছি।’
জানা গেছে, ভারতীয় ভিসার জন্য ই টোকেন সংগ্রহের নিশ্চয়তা দিয়ে নগরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী একটি দালাল চক্র। এ চক্রের সদস্য বিপুল ঘোষ, নোমান ও সুমন বিশ্বাস। বিপুল ও সুমন ভারতীয় ভিসা সেন্টারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, নোমান ভিসা সেন্টারের দালালদের নেতা। চক্রটি নগরের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে। তাদের কিছু লোক প্রায় প্রতিদিন ভারতীয় ভিসা সেন্টারের সামনে অবস’ান নেয়। আবেদনকারীর মতো লাইনে দাঁড়ায় তারা। অনেক সময় লাইন অতিক্রম করে ঢুকে যান ভিসা সেন্টারে।
প্রতিটি পাসপোর্টের বিপরীতে ভিসা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে চার থেকে ১২ হাজার টাকা। টাকা পরিশোধ করার তিন-চার দিনের মধ্যে পেয়ে যাচ্ছে ভিসা। কিন’ সাধারণ ভিসা প্রার্থীরা দিনের পর দিন চেষ্টা করেও সার্ভারে ঢুকতে পারছেন না। অনায়াসে অনলাইনে ঢুকে ই-টোকেন সংগ্রহের ফরম পূরণ করছে দালালচক্র। এভাবে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকার ই-টোকেন ‘বাণিজ্য’ করছে চক্রটি। টাকার একটি অংশ চলে যায় ভিসা সেন্টারের কতিপয় কর্মকর্তার পকেটে।
গতকাল দুপুরে সরেজমিন গেলে ভারতীয় ভিসা সেন্টারে কর্তব্যরত রাজিব নামের এক পুলিশ সদস্য জানান, গত রোববার এক দালালকে আটক করে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ। তবে ভিসা সেন্টারের সামনে থেকে দালাল আটকের বিষয়টি গতকাল বিকেলে অস্বীকার করেছেন খুলশি থানার ওসি নিজাম উদ্দিন।
জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করে ৬০০ টাকা পরিশোধ করে পাওয়া যায় ভারতীয় ভিসা। চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চারশ ভিসা ইস্যু করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে চিকিৎসার জন্য ভিসা দেওয়া হয় মাত্র ২০ জনকে। আর ভিসা প্রাপ্তিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন রোগীরা।
এছাড়া প্রতিদিন এক থেকে দেড়শ ভিসা পাওয়া যায় দালাল চক্রের মাধ্যমে। এসব ভিসাকে বলা হয় ‘কন্ট্রাক্ট ভিসা।’ এ ভিসা নিতে লাইনে দাঁড়াতে হয় না। ঝামেলা নেই ই- টোকেনেরও। কর্তৃপক্ষ অনলাইনে ই- টোকেন দেয়ার ব্যবস’া করলেও ভিসা প্রত্যাশীরা মনে করেন এ পদ্ধতিতে ভিসা পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে। নানা কারণে যারা ভারতে যাচ্ছেন ভিসা পেতে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন দফায় দফায়।
অভিযোগ প্রসঙ্গে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য নিতে গত রোববার বিকেলে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি রাকেশ রমনের দপ্তরে টেলিফোন করলে তার (রাকেশ রমন) ব্যক্তিগত সহকারী গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় স্বশরীরে হাইকমিশন অফিসে গিয়ে রাকেশ রমনের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
এরপর গতকাল সোমবার দুপুর পৌণে ১২টায় খুলশি থানার হাবীব লেইনে অবসি’ত ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন অফিসে গেলে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন প্রধান ফটকে কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মী। এসময় ফটক থেকে ইন্টারকমে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে রাকেশ রমনের ব্যক্তিগত সহকারীর সাথে কথা বলিয়ে দেয়ার অনুরোধ করলেও অপরাগতা প্রকাশ করেন ওই নিরাপত্তাকর্মী।
এরপর গতকাল বেলা একটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সুপ্রভাত থেকে দফায় দফায় ফোন করে কথা বলতে চাইলে রাকেশ রমনের ব্যক্তিগত সহকারী নানা অজুহাতে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এমনকি নিজের নাম জানাতেও অস্বীকৃতি জানান তিনি।সুত্র সুপ্রভাত
মহেশখালী কক্সবাজার নৌপথে মহেশখালীগামী একটি গামবোট দুর্ঘটনায় বোট থেকে পড়ে দুই যাত্রী নিখোঁজ হয়েছে বলে ...
পাঠকের মতামত