প্রকাশিত: ০৫/০৫/২০২১ ৫:৩৮ পিএম

কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ। উপজেলা সদর থেকে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের জেলেপল্লি জালিয়াপাড়া। একসময় এই জেলেপল্লি ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে ভরপুর। বিভিন্ন এলাকার লোকজন সেখানে গিয়ে আয়-রোজগার করতেন। নাফ নদী থেকে ধরা তাজা মাছ এবং মাছকে রোদে শুকিয়ে উৎপাদিত শুঁটকি সরবরাহ করা হতো টেকনাফ, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এলাকায় ছিল না কোনো অভাব-অনটন।

এখন পুরো পল্লি যেন মৃত্যুপুরী। এর অন্যতম কারণ, নাফ নদীতে চার বছর ধরে জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ। ফলে করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে দিশা হারিয়ে ফেলেছে এই পল্লির অন্তত চার হাজার মানুষ। রোজগারের বিকল্প ব্যবস্থাও এলাকায় নেই।

স্থানীয় সাবরাং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফজলুল হক বলেন, সব কটি জেলেপরিবারে অভাব-অনটন চলছে। পেশা হারিয়ে অধিকাংশ পরিবার নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ধার-দেনা ও অন্যের সাহায্যের ওপর। সাহায্য না পেলে ঠিকমতো চুলাও জ্বলছে না তাদের।

জীবিকায় দিশা নেই সখিনার

৩ মে, দুপুর ১২টা। শাহপরীর দ্বীপ বাজার থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে উত্তর দিকে হেঁটে পাঁচ কিলোমিটার গেলে জালিয়াপাড়া। বেড়িবাঁধের ঢালুতে শতাধিক পরিবারের পলিথিন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি ঝুপড়িঘর। সীমান্তসড়ক তৈরির সময় জেলেপল্লি থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে জেলেরা বাঁধের পাশেই আবাস গড়ে। কারণ, জীবিকার জন্য নাফ নদী ছাড়া তাঁদের কোনো বিকল্প নেই।

ঝুপড়িঘরগুলোর সামনে-পেছনে রোদে মাছ শুকানোর কিছু বাঁশের মাচা। দূরের বালুচরে পড়ে আছে শতাধিক মাছ ধরার নৌকা। মাছ ধরা বন্ধ থাকায় রোদে পুড়ে নষ্ট হচ্ছে কাঠের নৌকাগুলো। একটি ঝুপড়িঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সন্তান ও নাতনিদের সঙ্গে কথা বলছিলেন সখিনা খাতুন।

মাছ ধরা বন্ধ। তাই চুলাও জ্বলছে না সখিনা খাতুনের সংসারে

মাছ ধরা বন্ধ। তাই চুলাও জ্বলছে না সখিনা খাতুনের সংসারে

‘কেমন কাটছে আপনাদের জীবন?’ রাখঢাক না রেখে সখিনা খাতুনের (৪২) সাফ জবাব, ‘আগে রোজার সময় প্রতিদিন কয়েকটা ঘরে ইফতারি দিতাম। গরিব লোকজনকে সাহায্য–সহযোগিতা করতাম। পরিস্থিতি পাল্টে গেছে, এখন আমাদের অন্যের সাহায্যে চলতে হচ্ছে। সাহায্য না পেলে চুলাও জ্বলে না।’

ক্ষোভের সঙ্গে সখিনা খাতুন বলেন, ‘চার বছর ধরে আমরা নাফ নদীতে মাছ ধরতে পারছি না। নাফ নদী দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসছে, এই অজুহাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য মাছ ধরা বন্ধ রাখে সরকার।’ একটু থেমে সখিনার জিজ্ঞাসা, ‘ইয়াবা পাচার কি এক দিনও বন্ধ ছিল? বরং ইয়াবার চোরাচালান বেড়েছে কয়েক গুণ। তাহলে আমাদের (জেলেদের) ওপর এত অমানবিক আচরণ কেন?’

সখিনার স্বামী ফরিদ আলম জেলে। নাফ নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতেন তিনি। আর সখিনা কাঁচা মাছ কিনে শুঁটকি তৈরি করে বিক্রি করতেন বাজারে। সুখে–শান্তিতে চলছিল সংসার। সখিনার সংসারে ছয় ছেলেমেয়ে। এক মেয়ের বিয়ে হলেও এক ঘরেই সবার বসবাস।

নিজের দুঃখের ফিরিস্তি তুলে ধরে সখিনা বলেন, ‘রোজার শুরুতে ঘরের দামি কিছু কাপড়চোপড় বিক্রি করে চলেছি। এখন নাকের স্বর্ণের দুল বিক্রি করে কোনোমতে চলছি। সামনে ঈদ, কী হবে ভেবে পাচ্ছি না।’

আরেক জেলে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা ও লকডাউন পরিস্থিতিতে জেলেপল্লির ঘরে ঘরে অভাব চলছে। অভাব আমাদের লজ্জা-শরম কেড়ে নিয়েছে। সন্তানদের চেহারার দিকে তাকালে চোখে জল নেমে আসে। এখন এক বেলা খেয়ে কোনোমতে রোজা রাখছি, সামনে ঈদ। ছেলেমেয়েদের নতুন জামাকাপড় কিনে দেব, দূরের কথা, ঠিকমতো চুলাও জ্বলছে না।’ স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ আটজনের সংসার নুরুল ইসলামের।

একটি ঝুপড়িঘরের মেঝেতে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন অসুস্থ জেলে নবী হোসেন। স্ত্রী মোস্তফা খাতুন বলেন, ওষুধ কেনার টাকা নেই। আয়–রোজগারও বন্ধ। এখন ডাল-ভাত খেয়ে রোজা রাখছেন তিনি, পানিতেই রোজা ভাঙছেন। এমন জীবন চার বছর আগেও ছিল না তাঁর।

মাছ ধরার সুযোগ চান জেলেরা

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে নাফ নদীর ওপর দিয়ে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়। তখন এই ঢল থামানোর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। সঙ্গে নাফ নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু চার বছরেও সেই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়নি। নাফ নদীতে মাছ ধরার বিষয়টি তদারক করছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি।

জালিয়াপাড়া ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল গনি বলেন, ‘দীর্ঘ চার বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় জেলেদের কোটি টাকা বিনিয়োগে তৈরি দুই শতাধিক নৌযান ও মাছ ধরার জাল নষ্ট হচ্ছে। জেলে পরিবারগুলোর অমানবিক জীবনযাপনের কথা বিবেচনা করে সম্প্রতি আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। আমরা ন্যূনতম দিনের বেলায় কয়েক ঘণ্টা মাছ শিকারের সুযোগ চেয়েছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। জেলে পরিবারগুলো সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা থেকেও বঞ্চিত।’

এ প্রসঙ্গে উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, চার বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ ধরতে না পেরে জেলেরা বিপদে আছেন, তা সবার জানা বিষয়। তাঁদের দুর্ভোগ লাঘবে একটা পথ বের করার চেষ্টা চলছে। উপজেলা প্রশাসন, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মৎস্য সংগঠনের নেতাদের সমন্বয়ে যৌথ বৈঠকের মাধ্যমে জেলেদের এই দুরবস্থার নিরসন জরুরি। স্থানীয় প্রশাসন চাইলে সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটার মধ্যে নাফ নদীসংশ্লিষ্ট ১ হাজার ১৪১ জেলেকে ক্রমান্বয়ে মাছ শিকারের অনুমতি দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মাছ শিকারে যাওয়া ও আসার পথে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিজিবি কর্তৃক তাদের মনিটরিং করা সম্ভব।

এ বিষয়ে একমত পোষণ করে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাহেদ হোসেন বলেন, ইয়াবা চোরাচালান ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সরকার নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছে। কিন্তু ইয়াবা পাচার বন্ধ হচ্ছে না। কয়েক হাজার জেলে পরিবারের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে সরকারি সিদ্ধান্ত শিথিল করা দরকার।

মাছ ধরা বন্ধ থাকায় কক্সবাজারের টেকনাফের জালিয়াপাড়া প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে

মাছ ধরা বন্ধ থাকায় কক্সবাজারের টেকনাফের জালিয়াপাড়া প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে

উপজেলা মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসের শুরুতে মিয়ানমার থেকে নাফ নদী দিয়ে ইয়াবা পাচারের অভিযোগে মাছ শিকার বন্ধ করা হয়। এরপর একই বছরের ২৫ আগস্ট পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গার ঢল শুরু হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয় উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের কাছে। তখন থেকে নাফ নদীতে জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। এতে জালিয়াপাড়াসহ টেকনাফের অন্তত ১০ হাজার জেলে বিপাকে পড়েছেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পারভেজ চৌধুরী বলেন, কয়েক দিন আগে নাফ নদীতে মাছ ধরার সুযোগ চেয়ে জেলেদের কাছ থেকে একটি চিঠি তিনি পেয়েছেন। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। জেলেদের মানবিক দিককে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। সুত্র: প্রথম আলো

পাঠকের মতামত

ডালিম বড়ুয়া ও তার স্ত্রী তান্নি বড়ুয়া’র বিরুদ্ধে ঘুমধুমের অসহায় পরিবার’কে হয়রানি’র অভিযোগ

বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ঘুমধুমে বিএনপি, জামায়াত সহ অনেক নিরীহ পরিবারকে মামলা দিয়ে হয়রানির অহরহ ...

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছুরিকাঘাতে ঢাবি শিক্ষার্থী নিহত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। নিহত শিক্ষার্থীর নাম শাহরিয়ার আলম ...