
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলে নজিরবিহীন লুটপাটে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয় বেশ কয়েকটি ব্যাংকে। যা তখনকার সময় ‘শাক দিয়ে মাছ ঢেকে’ রাখার মতো চেপে রাখা হয়েছিল। হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রকাশ পেতে থাকে দুর্বল ব্যাংকগুলোর আসল চিত্র। তার ওপর মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয় গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের বেশ কিছু মন্তব্যে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন- ‘জালিয়াতি ও লুটপাটে দেশের ১০ ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে’।
তার এই মন্তব্য আগুনে পানির বদলে ঘি ঢালার মতো অবস্থা হয়। সেই বক্তব্যের পরও শরিয়াহভিত্তিক দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে ধারাবাহিকভাবে মন্তব্য করে যাচ্ছেন তিনি। তার এই বক্তব্যে এসব ব্যাংকে আরও অস্থিরতা চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংকগুলো প্রতিনিয়তই হারাচ্ছে গ্রাহক। ঘুরে দাঁড়ানোর বদলে উল্টো ধসে পড়ছে এসব ব্যাংক।
গভর্নরের বক্তব্যের ওপর কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না। তিনি অভিভাবক হিসেবে নানাদিক ভেবে-চিন্তে বক্তব্য দিয়েছেন।
আরিফ হোসেন খান, মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক; বাংলাদেশ ব্যাংক
সবশেষ গত ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গভর্নর বলেন, ইসলামি ব্যাংকগুলোকে একদম নতুন রূপ দেওয়া হবে। একটি বড় ও অনেকগুলো ছোট ছোট ইসলামি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি সমস্যাগ্রস্ত। এসব ব্যাংক একীভূত করে বড় দুটি ইসলামি ব্যাংক গড়ে তোলা হবে। ইসলামি ব্যাংকের জন্য আইন ও তদারকির ব্যবস্থা চালু করা হবে। বৈশ্বিক পরিসরের উত্তম রীতিনীতি অনুসরণ করে এসব করা হবে।
ব্যাংকাররা বলছেন, শরিয়াহ পরিচালিত ইসলামি ব্যাংকগুলো একীভূত করে দুটো ব্যাংক করার ঘোষণায় ইসলামি ব্যাংকগুলোর গ্রাহকের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। মাসখানেক আগেও তিনি জানিয়েছিলেন সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও কিছু ব্যাংক বাঁচানো সম্ভব হবে না। তার এসব বক্তব্যের কারণে অনেক গ্রাহক আতঙ্কিত হয়ে ‘দুর্বল ব্যাংক’ থেকে টাকা তুলে কথিত সবল ব্যাংকে রাখতে শুরু করেছেন।
সূত্র জানায়, পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ একটি বিশেষ মহলের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্য ২০২২ সালের আগস্টে ১০টি ব্যাংককে দুর্বল হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। যা পুরো ব্যাংক খাতকে সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। পরে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তথাকথিত সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার তড়িঘড়ি প্রয়াস পান। এতে বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা বাগড়া দিয়ে বসেন। তবু তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মার্জার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন। ততদিনে দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহক এবং ব্যাংকারদের পারদের উচ্চতা বেড়ে যায়। চারদিকে ব্যাংক একীভূতের নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘটা করে জানিয়ে দেয়, ১০ টির বেশি ব্যাংক একীভূত হবে না। এতে ব্যাংক খাতে অনেকটা স্বস্তির দেখা মিলে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে আত্মগোপনে যান তৎকালীন গভর্নর। কিন্তু রউফ তালকদারের দেখানো পথেই যেন হাঁটছেন বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি ব্যাংক নিয়ে বারবার ‘বেফাঁস’ মন্তব্য করছেন। তিনিও ১০ ব্যাংকে দুর্বল দাবি করেছেন। যা দুর্বল ব্যাংকগুলোর অস্তিত্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। গত ২৩ সেপ্টেম্বর গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানান যে, দেশের বেসরকারি খাতের কয়েকটি ছোট ব্যাংক একীভূত হতে পারে। একই মন্তব্যের প্রতিধ্বনি তুলে গত বছরের ২ এপ্রিলও কিছু ব্যাংককে একীভূতের কথা জানান তিনি। এতে আবার ব্যাংক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহক সবল ব্যাংকে যাচ্ছে। এতে শক্তিশালী ব্যাংকের আমানত বাড়ছে। আর দুর্বল ব্যাংকে লেগেছে শনির দশা।
গভর্নর দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলছেন। এসব কথা বললে তো দুর্বল ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হচ্ছেন সব ব্যাংকের অভিভাবকের মতো। অভিভাবক কখনো তার সন্তানদের কে ‘সবল’ কে ‘দুর্বল’ এসব মানুষের সামনে বলে বেড়ান না। যখন তখন গভর্নর দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলছেন। এসব কথা বললে তো দুর্বল ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।’
ইসলামি ধারার একটি ব্যাংকের এমডি জানান, ইসলামি ব্যাংকগুলোর পেছনে একটি বড় শক্তি বিরোধিতা করছে। সেই শক্তির বাহকরা নানা কৌশলে ইসলামি ব্যাংকগুলো ধ্বংস করতে পাঁয়তারা করছে। আর গভর্নরের বক্তব্যের পর তো ইসলামি ব্যাংকের গ্রাহকরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তাদের আশঙ্কা, যদি কোনো ব্যাংক বন্ধ হয় তবে আমানত তো মার যাবে। সুতরাং আমানত বাঁচাতে তারা সবল ব্যাংকর দিকে ঝুঁকছেন। তবে যাদের ইসলামি ব্যাংকে আস্থা বেশি তারা হয়ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। কিন্তু একীভূত যদি শুরু হয়, একটা পর্যায়ে ইসলামি ব্যাংক হয়তবা আর থাকবে না।
গভর্নর কী করবেন তা ঘটা করে বলার প্রয়োজন নেই। গভর্নের মন্তব্যের জের ধরে অনেক ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
—দুর্বল ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ক্ষোভ
দুর্বল ব্যাংকের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালকদার দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে যে পথে হাঁটছিলেন ঠিক বর্তমান গভর্নরও যেন একই পথে হাঁটছেন। গভর্নর কী করবেন তা ঘটা করে বলার প্রয়োজন নেই। গভর্নের মন্তব্যের জের ধরে অনেক ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। দুর্বল ব্যাংক জানার পর গ্রাহক কেন জেনেবুঝে বিপদগ্রস্ত ব্যাংকে লেনদেন করবে। কোন সখে দুর্বল ব্যাংকে টাকা জমা রাখবে। তারা তো নিরাপদ এবং বাড়তি প্রাপ্তির আশায় সবল ব্যাংকে চলে যাবে। আর দুর্বল ও সবল ব্যাংক গ্রাহকের কাছে অনেকটা পরিষ্কার। এমন পরিস্থিতিতে কিছু ব্যাংক লাভবান হচ্ছে। আর দুর্বল ব্যাংক হিসাবে পদ্মা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি, ইউনিয়ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। এছাড়া জনতা ও বেসিক ব্যাংক দুর্বলের খাতায় রয়েছে। এসব ব্যাংকের গ্রাহক স্বভাবতই সবল ব্যাংকে ঝুঁকবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, গভর্নরের বক্তব্যের ওপর কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না। তিনি অভিভাবক হিসেবে নানাদিক ভেবে-চিন্তে বক্তব্য দিয়েছেন। তবে কিছু শরিয়াহ ব্যাংক যে দুর্বল তা গোপন করার কিছু নেই। আর গ্রাহক সিদ্ধান্ত নেবে এসব ব্যাংকে টাকা রাখার বিষয়টি। আর ঝুঁকি এড়াতে সবল ব্যাংকে টাকা রাখা দোষের কিছু না। তথ্যসূত্র,, ঢাকা মেইল
পাঠকের মতামত