
# ৩০ জুন থেকে থাকছে না এনজিওর অধিনের পদায়ন করা চিকিৎসকসহ ১৯৯ কর্মকর্তা-কর্মচারি
# বন্ধ হয়ে যেতে পারে আইসিইউ, সিসিইউ সহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ
# ময়লা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নামবে বিপর্যয়
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল ২০২২ সালে সরকার ঘোষিত সারা দেশের মডেল হাসাপাতাল। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের এক পরিপত্রে ৮ টি বিষয় বিবেচনা করে এমন ঘোষণা প্রদান করা হয়েছিল। আর কক্সবাজার জেলার সর্বোচ্চ সরকারি চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানটির জন্য একটি দু:সংবাদে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন স্বয়ং চিকিৎসক সহ সংশ্লিষ্ট মহল। উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় রয়েছেন জেলার সর্বশ্রেণী-পেশার মানুষও।
আর সেই দু:সংবাদটি হল, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এনজিওর অধিনে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পদায়ন করা চিকিৎসক সহ ১৯৯ কর্মকর্তা ও কর্মচারি থাকছেন না আগামি ৩০ জুন থেকে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ বা অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এই ১৯৯ কর্মকর্তা ও কর্মচারি চাকুরি হারাচ্ছেন।
এতে হাসপাতালটি ভর্তি রোগী, বর্হিঃ বিভাগ ও জরুরি বিভাগের চিকিৎসা সেবায় বিপর্যয় নেমে আসার আশংকা করছেন স্বয়ং হাসপাতালটি চিকিৎসক সহ সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয় এই বিশাল জনবল শূণ্যতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত আইসিইউ, সিসিইউ সহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিভাগই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিঘ্ন ঘটতে পারে হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে।
কক্সবাজার জেলার সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবার সরকারি প্রতিষ্ঠান কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল। এটি জেলার ২৫ লাখ মানুষের পাশাপাশি ২০১৭ সালের পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়রত ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির সেবা প্রদান করে আসছে। সরকারি সিদ্ধান্তের আলোকে রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দকৃত মোট অর্থের ২৫ শতাংশ স্থানীয় জনগোষ্ঠির কল্যানে ব্যয় করার আদেশ রয়েছে। হাসপাতালটিতে জেলার স্থায়ী জনগোষ্ঠি সহ বিশাল অংকের রোহিঙ্গা চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। এর প্রেক্ষিতে হাসপাতালটি আধুনিকায়ন, চিকিৎসা সেবার উন্নত করতে স্থানীয় জনগোষ্ঠির কল্যানে ব্যয়ের বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নানা প্রকল্প শুরু করা হয়। বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এনজিও সংস্থার অধিনে প্রকল্পের মাধ্যমে হাসপাতালের সেবা পরিধি বৃদ্ধি, জনবল নিয়োগ প্রদান করা হয়।
কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেয়া সর্বশেষ ১ জুনের তথ্য বলছে, স্থানীয় জনগোষ্ঠির কল্যানে ব্যয়ের বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৬ টি সংস্থার অধিনে ১৯৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারির পদায়ন রয়েছে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে। এই ৬ টি সংস্থা হল, আইওএম, ইউনিসেফ, ইউএসএফপিএ, শেড। যেখানে আইসিইউ ও সিসিইউ পরিচালনার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সহ মোট ৪৬ জন চিকিৎসক রয়েছেন। এছাড়া রয়েছেন নার্স ও মিডওয়াইফ ১৩ জন, বায়ো মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ান ১ জন, মেডিকেল টেকনোলজিস ৫ জন, ল্যাবরেটরি টেকনোলজিস ২ জন, রিডওলজি টেকনোলজিস ২ জন, লাইফ অপারেটর ১ জন, অ্যাম্বুলেন্স চালক ১ জন, বৈদ্যুতিক কারিগার ১ জন, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ৩৮ জন, ওয়ার্ড মাস্টার ১ জন, আনসার সদস্য ১৫ জন, নিরাপত্তা কর্মী ৭ জন, ওয়ার্ড বয়/আয়া ২০ জন, অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) সহযোগি ৬ জন, সিনিয়র ফার্মাসিস্ট ১ জন, ল্যাব সহকারি ২ জন, স্টোর কিপার ১ জন, ডাটা অপারেটর ১ জন, আইএমসআই বিশেষজ্ঞ ২ জন, ক্লিনিক্যাল বিশেষজ্ঞ ৪ জন, সমন্বয়কারি ১ জন, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ১ জন, টিকেট বিভাগে ৫ জন, ম্যানুয়ার ওর্য়াকার ১০ জন, কেস ওর্য়াকার ২ জন, ইডি সহযোগি ৮ জন, স্যানিটারি কর্মী ১ জন।
এর বিপরীতে ২৬ জুন বুধবার প্রাপ্ত তথ্য বলছে, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের সরকারি মঞ্জুরিকৃত ৩২৮ টি পদের মধ্যে ৭৬ টি শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর ৬৮ টি চিকিৎসকের পদে কর্মরত রয়েছেন ৫২ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীর নার্সের ১৮০ টি পদে কর্মরত রয়েছেন ১৫৭ জন, তৃতীয় শ্রেণীর ৩৬ পদে ৩১ জন এবং চতুর্থ শ্রেণীর ৪৪ পদে ১২ জন কর্মরত রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, স্থানীয় জনগোষ্ঠির কল্যানে ব্যয়ের বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৬ টি সংস্থার পরিচালিত প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৩০ জুন। ফলে ৩০ জুনের পর আর থাকছে না ১৯৯ জন কর্মকর্তা ও কমচারীরা। এতে হাসপাতালটি ভর্তি রোগী, বহিঃ বিভাগ ও জরুরি বিভাগের চিকিৎসা সেবায় বিপর্যয় নেমে আসার আশংকা করছেন স্বয়ং হাসপাতালটি চিকিৎসকরা।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. আশিকুর রহমান জানান, প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩ হাজার রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আসছেন। কিন্তু সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক বা জনবল দ্বারা চিকিৎসা প্রদান কঠিন এবং হিমশিম খেতে হবে। জরুরি বিভাগে বর্তমানে ১৫ জন চিকিৎসকের পরিবর্তে ২ জনকে সামলাতে হবে। এটা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, সরকার ঘোষিত সারা দেশের মডেল হাসাপাতাল হওয়ার ক্ষেত্রে যে ৮ টি কারণ রয়েছে তাতে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স সহ সংশ্লিষ্ট সকলেই দেশের অন্যান্য জেলা হাসপাতালের চেয়ে বেশী সেবা প্রদান, বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা পর্যায়ের হাসাপতালের চেয়ে বেশি রোগীর সেবা প্রদান এবং এ হাসপাতালের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কথা বলা হয়েছে। এটা সম্ভব ছিল অতিরিক্ত জনবলের কারণে। এখন তার উল্টোটা হবে। চিকিৎসা সেবা বিপর্যয়ের পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা নিয়ে তৈরি হবে জটিলতা। এমন কি মাত্র কয়েক সপ্তাহে নোংরা পরিবেশই বিরাজ করতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা ভেস্তে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ করেছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মং টিং ঞো।
তিনি জানিয়েছেন, বিষয়টি ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর সহ সংশ্লিষ্টদের লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠানের সাথে স্বাস্থ্য বিভাগের জরুরি আলাপ আলোচনা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠার আইএসও অধিনে কর্মকর্তা-কর্মকর্তাদের পদায়ন করার আলোচনা চলছে। এটা হতে কম হলেও দুই-তিন মাস লাগতে পারে। এর মধ্য বিভিন্ন স্থান থেকে সরকারিভাবে ১৫ জন চিকিৎসক আনা হবে। এদের দিয়েই চিকিৎসা সেবা স্বাভাবিক রাখা হবে।
হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের জানান, বিশ্বব্যাংকে অর্থায়নে নিয়োগকৃত জনবল দিয়েই হাসপাতালে আন্তর্জাতিক মানের জরুরি বিভাগের চিকিৎসা সেবা, ঔষধ প্রদান, রোগীর জন্য পরীক্ষা- নিরিক্ষা, নিবিড় শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র, আইসিইউ, সিসিইউ ও ২৪ ঘন্টা প্যাথোলজি ব্যবস্থা ছিল। আর এসব কারণে এটি মডেল হাসপাতাল। জনবল না থাকলে তা রক্ষা করা যাবে না। জেলা সদর হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানের আইসিইউ, সিসিইউ বন্ধ হয়ে যাবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এটা রক্ষা করতে উদ্যোগ নিতে হবে। না হয় জেলাবাসি, বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির চিকিৎসা সেবায় চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। ভয়াবহ হবে কক্সবাজারের চিকিৎসা সেবা খাত।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মো. মাহাবুবুর রহমান জানান, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ চালুর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আজ পর্যন্ত চালু হয়নি। এটা চালুর জন্য কাজ চলছে। এখন জেলার সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবার জন্যই সদর হাসপাতাল। এটার উপর জেলাবাসি, রোহিঙ্গা নির্ভরশীল। এটা রক্ষায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে উদ্যোগ গ্রহণের ব্যর্থ হলে চিকিৎসা সেবার বেহাল পরিস্থিতি তৈরি হবে।
রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের একটি অংশ স্থানীয়দের জন্য। আর সেই অর্থে হাসপাতালের জনবলটি নিয়োগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গার জন্য অর্থ বরাদ্দ আছে, আসছে। এখানে হাসপাতালের প্রকল্প বন্ধ হওয়ার কারণ কি পরিষ্কার না। এটা এনজিও সংস্থার কোন সূক্ষ খেলা কিনা এটাও দেখা জরুরি। মনে রাখতে হবে এনজিওগুলোর নিজেদের স্বার্থে হাসপাতালের প্রকল্প অব্যাহত রাখতে হবে। এখানে জেলাবাসি, বিশাল রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা ছাড়াও দেশী-বিদেশী সংস্থা কর্মরত দেশী-বিদেশী কর্মকর্তাও চিকিৎসা নেন। এই চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেস্তে দেয়া যাবে না। এটা রক্ষা নাগরিকদের দায়িত্বও বটে.।সুত্র, দৈনিক কক্সবাজার
পাঠকের মতামত