আবু তাহের ও আবদুর রহমান, টেকনাফ থেকে::
সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ থামছে না। অনুপ্রবেশকারীদের দাবি, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে তাদের হয় হত্যা নতুবা উদ্বাস্তু করার নীতি নিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা তাই সেনাসদস্যদের হত্যা, ধর্ষণ, গুলিবর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও হামলার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ে-জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সুযোগ খুঁজছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের। গতকাল সোমবার এক দিনেই এক হাজার একশ’ রোহিঙ্গা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এ দেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তাদের মধ্যে সাত শতাধিক আশ্রয় নিয়েছে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে। দেড় শতাধিক আশ্রয় নিয়েছে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে এবং আরও প্রায় আড়াইশ’ রোহিঙ্গা বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। তাদের সবাই আবার তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। অনুপ্রবেশকারীদের অবস্থান ও গতিবিধি নজরদারির মধ্যে না থাকায় অনেকেই শঙ্কিত। এদিকে কিছুসংখ্যক দালাল রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত এমন ১৪ দালালকে আটকের পর ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
‘ছোট শিশু থাকলে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে’: সরেজমিনে সমকালের প্রতিনিধিরা দেখেছেন, গতকাল সোমবার মধ্যরাত থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে সাত শতাধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। এনজিও সংস্থা অ্যাকশন ফেইমের (এসিএফ) কর্মী সাজেদা বেগম নতুন আসা রোহিঙ্গাদের তালিকাভুক্ত করছেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সব রোহিঙ্গাকে তালিকাভুক্ত করি না। শুধু যাদের ছোট শিশু রয়েছে তাদের তালিকাভুক্ত করে শিশুদের জন্য কিছু পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করি।’ তিনি বলেন, ‘সোমবার ভোর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত প্রায় সাত শতাধিক রোহিঙ্গা নতুন করে ক্যাম্পে অনুপ্রবেশ করেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে এরা আশ্রয় নিচ্ছে।’
অবস্থান ও গতিবিধি জানা যাচ্ছে না: ক্যাম্পের এ ব্লকের মাঝি আবদুল হাফেজ জানান, রাতের অন্ধকারে এসে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে। তবে অনেকে পরে এখান থেকে বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে। তাদের অবস্থান ও গতিবিধিও জানা যাচ্ছে না। সকাল ১০টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং বাজার স্টেশনে দেখা যায় দুটি রোহিঙ্গা পরিবার চাঁদের গাড়িতে উঠে অজ্ঞাত স্থানে চলে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা পরিবারটি জানায়, সোমবার ভোর রাতে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে প্রথমে কুতুপালং ক্যাম্পে আসে। এখন তারা কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী এলাকায় বসবাসরত আত্মীয়স্বজনের কাছে চলে যাচ্ছে।
জঙ্গলে জন্ম পলাতক মিনারার কন্যাশিশুর: মংডুর কেয়ারিপাড়া থেকে ১০ দিনের কন্যাশিশুকে কোলে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন রোহিঙ্গা নারী মিনারা বেগম। তিনি জানান, গতকাল সোমবার রাতের আঁধারে নাইছাপ্রু সীমান্ত দিয়ে আরও ১৫ জনের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। ১৮ দিন আগে বর্মী সেনারা তাদের গ্রামে হামলা চালায়। সেনারা তার বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে স্বামী দোস্ত মোহাম্মদকে ধরে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘স্বামীর খোঁজ আর পাইনি। শুনেছি গলা কেটে লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছে।’ তিনি জানান, মিয়ানমার সেনারা পাড়ার দেড় হাজারের বেশি ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। হত্যা করেছে অনেক পুরুষ ও নারী-শিশুকে। তাদের মধ্যে রয়েছে তার তিন ভাই আবদুল খালেক (৩০), ফোরকান আহমদ (২৭) এবং সিরাজ আহমদ (২২)।
মিনারার ভাষ্যমতে, প্রতিবেশী একটি পরিবারের সঙ্গে জঙ্গলে একদিন পালিয়ে থাকার পর নাইছাপ্রং এলাকার একটি বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানেই জন্ম হয় তার কন্যাসন্তানের। তিনি বলেন, ‘বাঁচার জন্য, শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য এ দেশে পালিয়ে এসেছি। আমার মেয়েটি তারা বাবাকে দেখতেও পেল না। তাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব!’
মংডুর নাইছাপ্রু এলাকার গৃহবধূ সাজেদা বেগম তার তিন সন্তান ইয়াছিন (১২), আয়াজ (৮) ও ইয়াসমিনকে (৪) নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। সোমবার সকালে কুতুপালং ক্যাম্পে সমকালকে তিনি জানান, স্বামী আবুল আলাকে হত্যা করে তাদের ঘর আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছে মিয়ানমার সেনারা। প্রতিবেশী আরও অনেকের সঙ্গে গতকাল সোমবার সকালে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন এই রোহিঙ্গা নারী। কুতুপালং ক্যাম্পে জিয়া নামে একজন রোহিঙ্গার ঘরে উঠেছেন তিনি। মংডুর হাতিপাড়া থেকে রোববার রাতের আঁধারে পালিয়ে এসেছেন মো. সেলিম। সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী তৈয়বা বেগম ও তিন সন্তান। তিনি জানান, বর্মী সেনারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করছে। নারীদের ধর্ষণ করছে। আরাকানকে রোহিঙ্গাশূন্য করার জন্য পরিকল্পিতভাবেই তারা কথিত এ অভিযানে নেমেছে।
লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেড় শতাধিক: গতকাল সোমবার দুপুরে টেকনাফ উপজেলার লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে খবর পাওয়া যায়, একদিনেই দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা এখানে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
মংডুর বড়গজি বিল এলাকা থেকে পালিয়ে এসেছেন শাহিদা বেগম (৪০)। লেদা ক্যাম্পে তিনি সমকালকে জানান, তার বড় মেয়ে ১৫ বছরের সুপাইদা বেগমকে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমার সেনাসদস্যরা। তাকে আর পাওয়া যায়নি। বাকি তিন মেয়ে ও চার পুত্রসন্তানকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন এই রোহিঙ্গা গৃহবধূ। তার স্বামী মৌলবি জাফর হোসেন স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক। তিনি এখন কোথায় রয়েছেন তা জানা নেই তার।
অনুপ্রবেশকারীরা জানায়, বর্মী সেনারা মংডু এলাকার রোহিঙ্গা নেতাদেরও ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন বড়গজি বিল এলাকার মওলানা একরাম, মৌলবি নূর হোসেন, মৌলবি আহমদ উল্লাহসহ আরও কয়েকজন।
চলছে সেনাবাহিনীর কথিত অভিযান: উখিয়া ও টেকনাফে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারের কথিত অভিযানে তাদের মতো ৩০ হাজার মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে। এতে অন্তত তিন শতাধিক ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের দাবি, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে রোহিঙ্গাদের হয় হত্যা না হয় উদ্বাস্তু করার নীতি নিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। কোনো পাড়ায় হত্যা-ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে এবং গ্রামবাসী রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশে চলে আসছে। এ দেশে আসতে গিয়ে নৌকাডুবিতেও মারা যাচ্ছে অনেক নারী-শিশু। তারা জানায়, সেনা অভিযানে আহত অনেকে বিনা চিকিৎসায়ও মারা যাচ্ছে। কারণ রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো চিকিৎসাসুবিধা নেই। কোনো বিদেশি সংস্থাকেও রাখাইন রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।
অনুপ্রবেশ বন্ধের চেষ্টা: টেকনাফে বিজিবি ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, গত বৃহস্পতিবার ভোরে নাফ নদীর চারটি পয়েন্ট দিয়ে দেড় শতাধিক রোহিঙ্গাবোঝাই আটটি নৌকা অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। বিজিবি সদস্যরা তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দিয়েছে। তিনি আরও জানান, এর আগেও এখানে আসা অনেক রোহিঙ্গাকে ওষুধ, খাবারসহ বিভিন্ন মানবিক সহায়তা দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
বিজিবি অধিনায়ক জানান, কিছু সংখ্যক দালাল রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত ১৪ দালালকে আটক করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন।
পাঠকের মতামত