উখিয়া নিউজ ডেস্ক:: কক্সবাজারের মিয়ামনমার সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একদিকে গোয়েন্দা বিভাগ ও পোশাকধারী পুলিশের ইয়াবাবিরোধী অভিযান চলছে, অপর দিকে তাদের প্রতিরোধে সংঘবদ্ধ হামলার একাধিক ঘটনা সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে।
এ ধরনের ঘটনায় ইয়াবা পাচারকারীরা সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে গেছে- এমন মন্তব্যও চলছে সচেতন মহলে। এ সব ঘটনার পেছনে কেউ কেউ পুলিশের কিছু অসাধু সদসেদ্যর লোভের ফসল বলেও মনে করছেন। এভাবে একের পর এক ঘটনার পেছনে ইয়াবা পাচারকারীদের সঙ্গে ‘লোভী পুলিশের’ হাত রয়েছে এমন ধারণা উড়িয়ে দিচ্ছে না অনেকে।
টেকনাফের সাবরাংয়ে ডিবি পুলিশ অভিযানে গিয়ে স্থানীয় জনতার হাতে অবরুদ্ধ হয়। তবে কয়েক ঘণ্টা পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও অন্য পুলিশের সহায়তায় তাদের উদ্ধার করা হয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা (!) হয়রানির অভিযোগে ডিবি পুলিশকে মারধরের চেষ্টা চালায়। এ ঘটনাটি গত ১২ জুলাই বুধবার রাতে সাবরাং ইউনিয়নের সিকদার পাড়া এলাকায় ঘটেছে।
এ ঘটনায় কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)র উপ-পরিদর্শক (এসআই) কামাল হোসেন বাদী হয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে মাদক ও সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে। মামলার পরপরই রাতে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩ আসামিকে আটক করে টেকনাফ মডেল থানা পুলিশ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার রাতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি টিম সাবরাং ইউনিয়নের সিকদার পাড়া এলাকার মৃত জহির আহমদের বাড়িতে ইয়াবা মজুদের গোপন সংবাদে অভিযানে গেলে বাড়ির গৃহিনী আর্তচিৎকারে স্থানীয় জনতা এগিয়ে এসে ডিবি পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে হামলা ও অবরুদ্ধ করে রাখে।
পরে খবর পেয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন ও প্যানেল চেয়ারম্যান শামসুল আলম ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে ডিবি পুলিশদের উদ্ধার করে সাবরাং বাজারস্থ কার্যালয়ে নিয়ে আসে। পরে থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাহির উদ্দীন খানের নেতৃত্বে একটি টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে ডিবি পুলিশের ওই টিমকে থানায় নিয়ে আসে।
অভিযানকারী ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) কামাল হোসেন জানান, সাবরাং সিকদার পাড়া মৃত জহিরের স্ত্রী রেহেনার বাড়িতে ইয়াবা মজুদের গোপন সংবাদে অভিযানে যান তারা। এসময় ঘরে হাড়ির ভেতরে লুকানো অবস্থায় পাঁচ হাজার পিচ ইয়াবাসহ তাকে আটক করা হয়। এতে স্থানীয় কিছু জনতা ছুটে এসে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালায় এবং আটক আসামিকে ছিনিয়ে নেয়।
এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে থানায় মাদক ও সরকারি কাজে বাধা প্রদানের দায়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে একইদিন রাতে টেকনাফ মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাহির উদ্দীনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম সাবরাং সিকদার পাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ মামলার তিন আসামিকে গ্রেফতার করেছে।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- সাবরাং সিকদার পাড়া এলাকার ফজল করিমের ছেলে শামসুল আলম (২০), একই এলাকার কবির আহাম্মদের ছেলে নূরুল আবছার (২৬) ও ওই এলাকার অবস্থানকারী টেকনাফ সদরের দঃ জাহালিয়া পাড়া এলাকার জব্বর মিয়ার ছেলে দিদার আলম (২৫)।
আসামিদের বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজার আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠায় পুলিশ।
এর আগে গত ১৮ মে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার সময় টেকনাফের নাজিরপাড়া গ্রামে পাচারকারীদের হামলায় কক্সবাজার গোয়েন্দা পুলিশ’র (ডিবি) দু’এএসআইসহ ৪ পুলিশ সদস্য ও গাড়িচালক আহত হন। ভাঙচুর করা হয় তাদের ব্যবহৃত গাড়িও। এ সময় একজনকে আটক করে টেকনাফ থানায় সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করে গোয়েন্দা পুলিশ। ওই দিন বৃহস্পতিবার রাতে ইয়াবা পাচারের সংবাদ পেয়ে কক্সবাজার গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম এসআই সুমনের নেতৃত্বে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজির পাড়া গ্রামের ইউপি সদস্য এনামুল হকের বাড়ি ঘেড়াও করে। এ খবরটি স্থানীয় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয় তার সর্মথকরা।
মাইকে বলা হয়, স্থানীয় ভুট্টো বাহিনীর লোকজন ডিবি দিয়ে এনাম মেম্বারকে তুলে নিতে আসে। মাইকে আওয়াজ শুনে শত শত নারী পুরুষ ঘেড়াও করে ডিবি’র গাড়িতে হামলা চালায়। এতে প্রাইভেট নোয়া মাইক্রোটি (চট্ট মেট্রো-চ-১১-১৬৮৬) তছনছ হয়।
আহত হন পুলিশের এএসআই আসাদুজ্জামান, ফিরোজ মিয়া, কনেস্টবল আল আমিন, সুমাইয়া সুলতানা ও গাড়িচালক বাপ্পি। পরে টেকনাফ মডেল থানা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে পুরস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। গাড়িসহ ডিবি সদস্যদের উদ্ধার করে।
এ ঘটনায় এসআই সুমন বাদী হয়ে এনামুল হককে প্রধান আসামি করে ৯ জন নামীয় ও ১৫০ জন অজ্ঞাত আসামি করে টেকনাফ মডেল থানায় মামলা দায়েক করনি। এ ঘটনায় পুলিশ নাজিরপাড়া গ্রামের আব্দুল হাকিমের ছেলে শামসুল আলম নামের এক যুবককে গ্রেফতার করেছে।
একইভাবে ২ মে মঙ্গলবার ভোররাত ৩টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং খারাংখালীতে টেকনাফ মডেল থানার একদল পুলিশ পূর্ব মহেশখালীয়া পাড়ার ঠান্ডা মিয়ার পুত্র বিকাশ দোকানদার আব্দুস সালাম (৪০) প্রকাশ ভূলুর বাড়ি ইয়াবাবিরোধী অভিযানে গিয়ে তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ১০লাখ টাকাসহ আটক করে। এরপর আটক ব্যক্তির বড় ভাই মুদি দোকানদার আবুল কাশেম প্রকাশ হাছিম সওদাগরের বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি চালিয়ে তাকেও আটক করে। আটকের এ খবরে সকাল থেকে স্থানীয় জনসাধারণ ক্ষুদ্ধ হয়ে খারাংখালী ষ্টেশনে টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কে বৈদ্যুতিক খুঁটি ফেলে, গাছপালা কেটে এবং টায়ার জালিয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। এমতাবস্থায় আতংকে স্থানীয় ব্যবসায়ী দোকান-পাট বন্ধ করে নিরাপদ স্থানে চলে যায়।
খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছলে বিক্ষুব্ধ জনসাধারণ পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও ধাওয়া করে। তখন পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকাগুলি ছোঁড়ে। পরে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপাধিনায়ক মেজর আবু রাসেল ছিদ্দিকী ও ওসি মাঈন উদ্দিন খাঁনের নেতৃত্বে অতিরিক্ত পুলিশ-বিজিবি ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়। এ ঘটনায় নগদ প্রায় ৯ লাখ ৯৫ হাজার নগদ টাকা ও ইয়াবা পাচারের বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার সংক্রান্ত মামলা দায়ের করা হয়।
এর আগে গত ৬ মে কক্সবাজারের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, ইয়াবা ব্যবসায়ী যত বড় শক্তিশালী হোক, ছাড় দেওয়া হবে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর নতুন করে তৎপর হয়ে ওঠে আইনশৃংখলা বাহিনী। ইতিমধ্যে পুলিশ ও বিজিবি’র বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্টদের সাথে বসে ইয়াবা উদ্ধার ও পাচারকারীদেরে ধরতে বিভিন্ন কৌশল নির্ধারন করে। জোরদার করে ইয়াবাবিরোধী অভিযান। যদিও বড় ধরনের সাফল্য এখনো দেখাতে পারেনি পুলিশ।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব নুরুল বশর বলেন, কিছু পুলিশ সদস্যের লোভের কারণে টেকনাফে পাচারকারীরা আস্কারা পেয়ে যাচ্ছে। চিহ্নিত ইয়াবা পাচারকারীদের আটক করে মোটা অংক হাতিয়ে নেওয়ার প্রবণতা যেমন বাড়ছে তেমনি নিরীহ আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের হয়রানি করে দমন পীড়নের পথও তৈরি করেছে স্থানীয় কিছু পুলিশ কর্মকর্তা। যার ফলে পাচারও বন্ধ হচ্ছে না, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চরম নাভিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দেওয়া লিখিত দরখাস্তের তদন্ত শুরু হয়েছে বলেও জানান।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি মোঃ মাঈন উদ্দিন খান বলেন, “পুলিশ অভিযান না করলেও বদনাম, করলেও বদনাম। এরপরও টেকনাফ মডেল থানার পুলিশ সদস্যরা বেশ কিছু বড় ইয়াবার চালান উদ্ধার করেছে। এবং বেশ কয়েকজন পাচারকারীকে আটক করে আদালতে সোর্পদও করেছে।”
তিনি আরো বলেন, এখানে ইয়াবা পাচারকারী সিন্ডিকেট বেশ শক্তিশালী। চেনা যায় না কে পাচারকারী, কে পাচারবিরোধী। অনেকে আবার জনপ্রতিনিধি হয়ে সমাজে খবরদারীও করে চলেছেন। যে কারণে অভিযান পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, “ইয়াবা কারবারে জড়িত গডফাদারদের চিহ্নিত করা অনেকটা সহজ এখানে। এ পর্যন্ত যে সমস্ত পাচারকারী ইয়াবাসহ আটক হয়েছে, এরা কার নিকট আত্মীয়, এদের তদবিরকারক কে, কারা এদের পৃষ্টপোষক? কে কার কাছে ইয়াবাগুলো নিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি রির্পোটগুলো পর্যালোচনা করলেই তো গডফাদারের তালিকা বের হয়ে আসে। আর এসব গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলেও ইয়াবা পাচার বন্ধ কীভাবে হবে?”
তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, নেত্রী বুঝতে পেরেছেন ইয়াবা ব্যবসার সাথে বড় বড় রাগব বোয়ালরা জড়িত। তাই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন তাদের শায়েস্তা করতে হবে, প্রশাসনকে এ ব্যাপারে জিরো ট্রলারেন্স অবস্থান নিতে হবে। না হয় বার বার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর হামলার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে।
শীর্ষনিউজ
পাঠকের মতামত