
কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশন ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) এর ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।
গতকাল ২৫ জুলাই মঙ্গলবার, বেলা ১১টায় ৯২ আরামবাগ, আল খালিফ টাওয়ারে (কাবিলা বিল্ডিং, ৭ তলা) আল-হাইআতুল উলয়ার দপ্তর থেকে তার ফলাফল প্রকাশিত হয়।
ঐ পরীক্ষায় সারা বাংলাদেশ থেকে ৬ টি কাওমী শিক্ষাবোর্ডের ৭৩৭ টি মাদরাসার সর্বমোট ১৯ হাজার ৪৭২ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন।
প্রথমবার অনুষ্ঠিত এই কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় পাশের হার গড় ৮২.৮৫।
সেখানে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ২০ তম স্থান অধিকার করেন উখিয়ার হাফেজ রিদওয়ানুল কাদির।
তাঁর মোট প্রাপ্ত নাম্বার ৮৯৬। আর প্রথম স্থান অর্জনকারীর মোট প্রাপ্ত নাম্বার হলো ৯৩২।
সারা বাংলাদেশের মেধা তালিকায় তিনি ২০ নাম্বার হলেও আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের মেধা তালিকায় তিনি ২য় স্থান অর্জন করেছেন।
তিনি জামিয়া ইসলামিয়া টেকনাফ থেকে আল-হাই’আর কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাফেজ রিদওয়ানুল কাদির উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের ডিগলীয়া পালং গ্রামের আলহাজ্ব জনাব আব্দুল কাদের সাহেব ও আনোয়ারা বেগমের তৃতীয় সন্তান। তার পড়ালেখার হাতেখড়ি ডিগলীয়া পালং রহমানিয়া কাসেমুল উলুম মাদরাসায়। সেখানে হিফজ সমাপ্ত করেন এবং কয়েকবছর প্রাথমিক লেখাপড়া করে পাড়ি জমান ককসবাজার জেলার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন জামিয়া এমদাদিয়া আজিজুল উলুম পোকখালী। সেখানে উচ্চমমাধ্যমিক সমাপ্ত করেন। এরপর পাড়ি জমান উপমহাদেশের অন্যতম বিদ্যাপীট আল জামিয়া আল জামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রামে। সেখানে কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। এরপর ইসলামিক আইনের উপর উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বসুন্ধরা, ঢাকায়। সেখানে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে জামিয়াতুল আবরার কেরাণীগঞ্জ, ঢাকায় চাকরির মাধ্যমে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। সেখানে একবছর সফলতার সাথে দায়িত্ব আঞ্জাম করে চলে আসেন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী টেকনাফের জামিয়া ইসলামিয়া টেকনাফে। সেখানে তিনি কৃতিত্বের সাথে পাঠদান করে যাচ্ছেন।
এছাড়া লেখালেখির রাজপথেও রয়েছে তাঁর সরব পদচারণা। ইতিমধ্যে তারঁ তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে এবং বইগুলো যথেষ্ট পাঠকনন্দিত হয়েছে। বইগুলো হলো, যধাক্রমে-
১. ফিকহী সেমিনার স্মারক-১৫।
২. রাসূল সা. এর ভালোবাসা বনাম অবমাননা: প্রেক্ষিত আজকের বিশ্ব।
৩. আমাদের তারুণ্য: প্রসঙ্গ ফেইসবুক।
এছাড়াও তাঁর মাশায়েখে চাটগাম-২ নামে আরেকটি ঢাউস সাইজের প্রামাণ্য গ্রন্থ যন্ত্রস্থ রয়েছে।
সন্তানের এরকম সাফল্যে আপনার অনুভূতি কি? জানতে চাইলে গর্বিত পিতা আলহাজ্ব আব্দুল কাদের বলেন, এই পরম মুহূর্তে আমি আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া করছি। পরকালীন চিন্তা ভাবনা এবং দেশ ও দশের কল্যাণ ভাবনা থেকেই ছেলেকে আলেম-হাফেজ বানিয়েছি। নিজের আত্মজের এরকম অভাবনীয় সাফল্যে আমরা পরম আনন্দিত। আমার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আমি সকলের কাছে দুআ কামনা করছি।
পুরো বাংলাদেশে আপনি ২০ তম স্থান এবং ইত্তেহাদুল মাদারিসে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন, এখন আপনার অনুভূতি কী? জানতে চাইলে হাফেজ রিদওয়ানুল কাদির বললেন, আসলে এটি আমার জীবনের অন্যতম পরম মুহূর্ত। সর্বপ্রথম আমি আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতায় সিজদাবনত। এরপর আমার শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতার কথা স্মরণ করছি, যারা দ্বীনের রাজপথে আমাকে তুলে দিয়েছেন বলেই আজ আমি এ সম্মানের উপযুক্ত হতে পেরেছি। এরপর স্মরণ করছি জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সব শিক্ষককে, যারা নিজেদের পার্থিব স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের পেছনে অহর্নিশি পরিশ্রম করেছেন। সাথে বসুন্ধরা, ঢাকা ও জামিয়া পোকখালীর শিক্ষকবৃন্দের কথাও গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। আমার যেসব শিক্ষক দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, আল্লাহ তাদের কবরকে জান্নাতের বাগানে পরিণত করে দিন। আর যারা জীবিত আছেন, তাদেরকে দীর্ঘ সুস্থ জীবন দান করুন।
বিশেষ কোন শিক্ষকের গল্প জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে আমাদের কাওমী মাদরাসার সকল শিক্ষকই ভেরি ভেরি স্পেশাল। স্বার্থহীন। ছাত্রদের উন্নতির লক্ষ্যে রাত দিন কঠোর পরিশ্রম করেন। সেখানে রাত দিন কিংবা অফিস টাইম নেই। পুরো ২৪ ঘণ্ঠায় সেখানে কর্মব্যস্ততা। কাকে ছেড়ে কার কথা বলবো।
তবে বলতে দ্বিধা নেই যে, আমার জীবনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী শিক্ষক হলেন, জামিয়া পটিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস, খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও যুগের ইবনে খালদুন খ্যাত আল্লামা রহমতুল্লাহ কাউসার নেজামী হাফিজাহুল্লাহ। আমার জীবনে তাঁর অবদান অপরিসীম। হুজুর দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। হুজুরের সুস্থতার জন্য সকলের কাছে দুআ চাই।
আল্লাহ হুজুরের ছায়া আমাদের উপর দীর্ঘায়িত করুন।
বর্তমানে কোথায় আছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে ককসবাজারের ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া টেকনাফে কর্মরত আছি। আর হ্যাঁ! আমার পরীক্ষা দেয়ার পেছনে জামিয়া টেকনাফের স্বনামধন্য পরিচালক, দৈনিক সাগরদেশ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক, খ্যাতিমান আলেম ও সাহিত্যিক আল্লামা কিফায়তুল্লাহ শফীক দা. বা. এর উৎসাহপ্রদান এবং আমার সহকর্মী শিক্ষকবৃন্দের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা আমাকে বেশ উৎসাহ যুগিয়েছে। আল্লাহ তাঁদের সকলের উভয়জগতে মঙ্গল করুন।
আপনার এই যে ভালো রেজাল্ট? এর পেছনে কারণ কী? এর প্রত্যত্তুরে রিদওয়ানুল কাদির জানালেন, ভালো রেজাল্টের পেছনে সর্বপ্রথম আল্লাহর দয়া, পিতামাতা এবং বড়দের দুআর ভূমিকাটাই সবচেয়ে বেশি বলে আমি মনে করি। সাথে সাথে পরীক্ষার সময় কঠোর পরিশ্রম ও অনির্বচনীয় অধ্যবসায়ের ফল হলো এই ভালো রেজাল্ট। আর আমার পড়াশোনা নোটবই বা গাইড কেন্দ্রীক ছিলোনা। বরং কিতাবকে তার প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলো সামনে রেখেই অধ্যয়ন করার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি, একজন ছাত্র শুধুমাত্র গাইডকে কেন্দ্র করে মূল বইয়ের সাহায্য নেয়া ব্যতিরেকে পরীক্ষা দেয়া, এটা তার জন্য চরম আত্মঘাতী। তার মেধা এবং ক্যারিয়ার সবগুলোই হুমকির মুখে পড়বে এর কারণে। এজন্য কোন ছাত্র শুধুমাত্র গাইডের উপর নির্ভর করবে, এটা কখনো কাম্য নয়।
ভবিষ্যতে যারা রেজাল্ট করতে চাইবে, তাদের জন্য যদি কিছু বলতেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কোন ছাত্র যদি সর্বোচ্চ পরিশ্রম করে আল্লাহ তাআলা তাকে সন্দেহাতীতভাবে সফলতা দান করবেন। এজন্য ভালো রেজাল্ট সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য নিজের পরিশ্রমের সাথে সাথে আল্লাহর দিকে মনোযোগি হওয়ার কোন বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, বিগত ১১ এপ্রিল ২০১৭ তারিখ সন্ধ্যায় গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের সনদকে মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) এর সমমান প্রদানের ঘোষণা দেন।
১৩ এপ্রিল মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনের আলোকে গঠিত কমিটি কওমি মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদীসের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন “আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ।” এ প্রতিষ্ঠানের অধীনে গত ১৫ মে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সারাদেশের কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। মঙ্গলবার এ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবে। দাওরায়ে হাদীসকে মাস্টার্সের সমমান প্রদানের পর এটাই প্রথম পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় দেশের ৬টি কওমি শিক্ষাবোর্ডের ৭৩৭টি মাদরাসার ১৯ হাজার ৪৭২ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। ১৫ মে সারা দেশে একযোগে শুরু হয়ে ২৫ এ্প্রিল তা শেষ হয় কওমি শিক্ষা ধারার সর্ববৃহৎ এ পাবলিক পরীক্ষা।
পরিশেষে, এতটুকুই বলবো, আমাদের উখিয়ার কীর্তিমান সন্তান রিদওয়ানুল কাদিরের এই সফলতা পুরো উখিয়া বরং পুরো ককসবাজারের ভাবমূর্তি দেশের সামনে উজ্জ্বল করবে। এজন্য আমরা উখিয়াবাসী তাঁর এ সফলতায় গৌরবান্বিত। আল্লাহ তাআলা দেশ ও দশের কল্যাণে তাঁকে কবুল করুন এবং ইলম-আমলে বরকত দান করুন।
বি. দ্র. হাফেজ রিদওয়ানুল কাদির অনলাইনেও বেশ সক্রিয়। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি কী? সে সম্পর্কে তার তাত্ত্বিক লেখা যেকোন পাঠককেই মুগ্ধ করবে। তার ফেইসবুক আইডি-
Ridwanulkader।
(প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে-
হাফেজ মুহাম্মদ রিয়াদ।
উখিয়া, ককসবাজার)
পাঠকের মতামত