প্রকাশিত: ১৪/০২/২০২০ ২:২৫ পিএম

সাহাদাত হোসেন পরশ::

প্রতীকী ছবি

কক্সবাজারের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান মাদকের আন্ডারওয়ার্ল্ডে এক পরিচিত নাম। মাদক কারবারিদের তালিকায়ও তার নাম ছিল ওপরের দিকে। এবার তার নাম উঠল মানব পাচারকারীদের তালিকায়। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা মানব পাচারের পৃষ্ঠপোষক ও মূল হোতাদের যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে কক্সবাজার জেলায় এক নম্বরে রয়েছে মুজিবুরের নাম। ওই তালিকা পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তালিকাটি সমকালের হাতে এসেছে। এই তালিকা বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, শুধু কক্সবাজার জেলাতেই মানব পাচারকারী ১০১ জন। ভয়াবহ এ অপরাধে জড়িতদের সংখ্যা দেশের অন্য যে কোনো জেলার চেয়ে এখানে বেশি। এখানে মানব পাচারে জড়িত অনেকেই অত্যন্ত প্রভাবশালী। কেউ আবার ইয়াবা কারবার ও মানব পাচার- দুটোই চালাচ্ছে সমানতালে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সাগরতীরের এই জেলা মানব পাচারে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) শহীদুল আলম সমকালকে বলেন, কেউ যাতে বৈধ চ্যানেল ব্যবহার করে জনশক্তি রপ্তানির আড়ালে মানব পাচার করতে না পারে, সেদিকে সরকারের নজর রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, পাসপোর্টে বয়স বেশি দেখিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়। আবার বিপরীত ঘটনাও ঘটে।

তিনি বলেন, এ ধরনের কারসাজি শনাক্ত করতে বিমানবন্দরে কল্যাণ ডেস্ক রয়েছে। কেউ বৈধ লাইসেন্স নিয়ে অবৈধভাবে মানব পাচারের মতো ঘটনায় জড়ালে লাইসেন্স বাতিল ও অন্যান্য শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধরনের ঘটনা রোধ করতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়।

জানতে চাইলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ডিআইজি (অর্গানাইজড ক্রাইম) ইমতিয়াজ আহমেদ সমকালকে বলেন, মানব পাচারে জড়িত মূল হোতাদের অধিকাংশই পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশের বাইরে থাকে। তাই হোতাদের ধরা যায় না। দেশে দালালদের মাধ্যমে এ কারবার চালিয়ে যায় তারা। ইন্টারপোলের মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত মানব পাচারকারীদের আইনের আওতায় নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় ভিকটিমকেও বিদেশ থেকে উদ্ধার করে ফেরত আনা হচ্ছে।

সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে দায়ের করা ৬২১টি মামলার বিচার কক্সবাজারে চলছে। ২০১২ সালে আইনটি পাস হওয়ার পর গত জানুয়ারি পর্যন্ত এসব মামলা হয়। তবে এ সময়ের মধ্যে একটি মামলারও বিচার সম্পন্ন হয়নি। মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে এ ধরনের মামলার বিচারে আলাদা ট্রাইব্যুনালের বিধান নেই। ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এর বিচার চলছে।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার মানব পাচারের পুরোনো রুট হিসেবে পরিচিত। ২০১৫ সালে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় সহস্রাধিক বাংলাদেশিকে আটক করা হয়। অনেকে আবার পথেই খাদ্য ও পানির অভাবে মারা যায়। ওই বছরেই থাইল্যান্ডে গণকবর আবিস্কৃত হয়। এর পর মানব পাচার রোধে কিছুদিন ব্যাপক তৎপর ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এতে কিছুদিন কার্যত বন্ধ ছিল মানব পাচার। সম্প্রতি মানব পাচারকারীরা বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ গত ১১ ফেব্রুয়ারি সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে ট্রলার ডুবে অন্তত ১৫ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। এর আগে ২০ জানুয়ারি রাতে টেকনাফের বাহারছড়া উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর সময় ২৩ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করে পুলিশ। গত বছরের ২৪ নভেম্বর মহেশখালীর মগচর থেকে আরও ২৫ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে পুলিশ। ১৫ নভেম্বর উখিয়ার সোনারপাড়া উপকূল থেকে ১১ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে পাঁচজন তরুণী। ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতে পাচার করার সময় চুয়াডাঙ্গা থেকে দুই রোহিঙ্গা নারীকে আটক করে পুলিশ। ২৭ জানুয়ারি ঢাকার আফতাবনগরের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ১৩ রোহিঙ্গা নারীকে উদ্ধার করে র‌্যাব।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের পাচারে কক্সবাজারকেন্দ্রিক একটি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে। চাকরি দেওয়ার নামে তাদেরকে মূলত মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় নিয়ে ‘বিক্রি’ করে দিচ্ছে তারা। কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে কৌশলে তাদের ঢাকায় এনে বাংলা ভাষা শেখানো হয়। এর পর ভুয়া তথ্য দিয়ে নেওয়া হয় পাসপোর্ট। আবদুস সবুর নামে এক বড় দালালের মাধ্যমে গত এক বছরে চার শতাধিক রোহিঙ্গা নারীকে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। সবুর বর্তমানে মালয়েশিয়া পালিয়ে আছে। ভুয়া তথ্য দিয়ে দুটি পাসপোর্ট ব্যবহার করছে সবুর। তার বাড়ি কক্সবাজারের বালিয়াপাড়ার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে।

গত বছরের ১০ মে রাজধানীর খিলক্ষেতের একটি ফ্ল্যাট থেকে ২৪ রোহিঙ্গা নারীকে উদ্ধার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বিদেশে পাচারের জন্য তাদের ঢাকায় এনে জড়ো করেছিল সবুর ও তার সহযোগীরা। জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাচারকারী চক্রের এজেন্ট হিসেবে সবুরের হয়ে কাজ করে কানা রফিক ও মফিজ নামে দুই রোহিঙ্গা।

বিদেশে নেওয়ার জন্য যেসব রোহিঙ্গাকে টার্গেট করা হয় তাদের প্রত্যেক পরিবারের কাছ থেকে জনপ্রতি ২০-২৫ হাজার টাকা নেয় মানব পাচারকারীরা। তবে একেকজনকে বিদেশে পাঠাতে খরচ পড়ে দেড় লাখ টাকার কাছাকাছি। বাকি টাকা বিনিয়োগ করে সবুর। পরে রোহিঙ্গা নারীদের বিক্রি করে ওই টাকা তুলে নেয় সে। একেকজনকে ৪-৫ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। অনেক রোহিঙ্গা নারীকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে বিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখায় দালালরা। আবার রোহিঙ্গাদের কারও কারও স্বজনরা আগে থেকেই মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে।

কক্সবাজারে পৃষ্ঠপোষক ও মূল হোতা ২২ জন :কক্সবাজার জেলায় মানব পাচারকারীদের পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে সাবেক এমপি বদির ভাই মৌলভী মুজিবুর ছাড়াও রয়েছে শাহপরী দ্বীপের ধলু হোসেনের ছেলে বেলাল উদ্দিন, সুলতান আহমদের ছেলে মো. ইউনূছ, সালেহ আহমদের ছেলে ইসমাঈল ও জিয়াবুল, আবু শামা হাজির ছেলে ফিরোজ আহমদ, শাহপরী দ্বীপের ডাঙ্গরপাড়ার আবু তাহেরের ছেলে মো. হাসেম ওরফে পোয়া মাঝি, আব্দুল মোতালেবের ছেলে দেলোয়ার, সুলতান আহমদের ছেলে সাহাব মিয়া, মিস্ত্রিপাড়ার জালাল আহমদের ছেলে শরীফ হোসেন, মৃত হোসেনের ছেলে শরীফ হোসেন ভুলু, মো. হাসেমের ছেলে মো. সেলিম ওরফে লম্বা সেলিম, মীর আহমদের ছেলে আয়াছ, নজির আহমদের ছেলে সৈয়দ, উখিয়ার সোনারপাড়ার সামছুল আলমের ছেলে জালাল উদ্দিন, সোনারপাড়ার নুরুল কবিরের স্ত্রী রেজিয়া বেগম ওরফে ম্যাডাম রেবী, চ্যাপ্টাখালীর বেলাল চৌকিদার, থ্যাংখালীর আব্দুর রহমানের ছেলে মো. রুবেল, বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের সৈয়দ আকবরের ছেলে দিলদার মিয়া, কুতুপালংয়ের মো. কালামের ছেলে জাকির হোসেন।

সহায়তাকারী ৭৯ জন :কক্সবাজারে মানব পাচারকারীদের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে সৈয়দ করিম। সে কক্সবাজার পৌরসভার শমসু মাঝির ছেলে। এ তালিকায় আরও আছে কক্সবাজার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজান। তালিকায় আরও আছে ফিশারিঘাটের গোলাম সুলতানের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মাসুদ ওরফে আজাদ, উত্তর নুনিয়ারছড়ার নজরুল ইসলামের ছেলে জহিরুল ইসলাম ফারুক, মোজাম্মেল হকের ছেলে আজিম, সফি আলমের ছেলে মোস্তফা, সিরাজুল ইসলামের ছেলে সিদ্দিক, সাব্বির আহমদের ছেলে ফেরদৌস, আবু, ঘোনারপাড়ার শাহজাহান, মো. সুলতানের ছেলে আবু নফর (রোহিঙ্গা), মৃত মো. সফির ছেলে ইসমাঈল; রোহিঙ্গা সদস্য শাহ আলম ও তার স্ত্রী সাজেদা আক্তার সাজু, হাজীপাড়ার ইদ্রিসের ছেলে ফেরদৌস ওয়াহিদ বকুল, আবদুস শুক্কুরের ছেলে সিরাজুল ইসলাম, মৃত ওলা মিয়ার ছেলে নূর সফা, বদিউল আলমের ছেলে সেলিম, মো. আলী, মো. জুনুর ছেলে সাইফুল ইসলাম, ফজল করিমের ছেলে ফিরোজ, আমির হামজার ছেলে জিয়াবুল, রুমালিয়াছড়ার নুরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে আশরাফুল ইসলাম সজীব, মোসলেম উদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ সেলিম উল্লাহ ওরফে প্রকাশ মাস্টার, সোনারপাড়ার মীর আহাম্মদের ছেলে শফিউল আলম, ইসলাম মিয়ার ছেলে আব্দুল গফুর, হোসাইন বৈদ্যের ছেলে নুরুল কবির, আলী আহমদের ছেলে সুরত আলম, পশ্চিম সোনারপাড়ার সামছুল আলমের ছেলে জালাল উদ্দীন, পালং ডেইলপাড়ার আবদুস ছালামের ছেলে আবু তাহের, মাদারবুনিয়ার শফিকুর রহমানের ছেলে আব্দুল জলিল, মনির আহম্মদের ছেলে নুরুল আবছার, মো. শাকুরানের ছেলে আব্দুল জলিল, আব্দুল গফুরের ছেলে মো. শফিক, হোছেন বৈদ্যের ছেলে নুর কবির, মোহাম্মদ সুলতানের ছেলে জিয়াউল হক, জাকির হোসেন, সায়েদুল হক, ফারুক হোসেন, আবদুল গনি, মনজুর আলম, নুরুল কাদের, জসিম উদ্দিন, হারিয়াখালীর জিয়াউর রহমান, সিদ্দিক আহমদের ছেলে রশিদ আহমদ ডাইলা, সিদ্দিক আহমদ, সাবরংয়ের ইমাম হোসেন, মোহাম্মদ ইসলাম, শওকত ফারুক, আবদুল করিম, আব্দুল্লাহ, নয়াপাড়ার রশীদউল্লাহ ডাইলা, আবুল হাসিম, দলিল আহমদ, শফিক, আনার আলী, নুর আলম, সাবরংয়ের খুইল্যা মিয়া, বশির আহমদ, আবুল কাসেম, জাহাঙ্গীর, কাটাবুনিয়ার আজিজুর রহমানের ছেলে আবু তাহের, মৌলভী কামাল, জামাল মাঝি, নেজাম মাঝি, মো. শফি, আবদুল হাফেজ, সলিম, রশিদ উল্লাহ, আব্দুল শুক্কুর, হাবি ও বাজারপাড়ার মফিজুল আলমের ছেলে আল মাসুদ। সুত্র : সমকাল

পাঠকের মতামত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ, চট্টগ্রাম -কক্সবাজার সড়ক অবরোধ

চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জে অন্তত ২৫ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এর ...

কক্সবাজারের সাবেক জেলা জজ-ডিসিসহ পাঁচজনের বিচার শুরু

কক্সবাজারের মাতারবাড়ি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নথি জালিয়াতির মামলায় কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক ...