প্রকাশিত: ২৮/১১/২০২০ ৯:৩০ এএম

মিয়ানমারের মতো বাংলাদেশেও এখন ভয়ংকর বিপদের মুখে পড়তে হচ্ছে হাতিকে। তফাৎ এই, মাইন পুঁতে রাখায় হাতির মৃত্যু ঘটছে মিয়ানমারে আর বাংলাদেশে এই প্রাণীটিকে মারা হচ্ছে গুলি করে। কারা একের পর এক হাতি গুলি করে হত্যা করছে জানা নেই তা কারোরই। জানার চেষ্টাও করছেন না কেউ।
গত ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া এলাকার চাকফিরানির গ্রামের একটি বিলে মারা গেছে গুলিবিদ্ধ এক হাতি। একই স্থানে ঠিক এক বছর আগেও গুলি লেগে মৃত্যু ঘটেছিল আরেক হাতির। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন বনাঞ্চলে গত দুই বছরে এমন গুলিবিদ্ধ মৃত হাতি পাওয়া গেছে এক ডজনেরও বেশি। হাতি হত্যার সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের খুঁজে বের করতে আন্তরিক নয় বন বিভাগ। হাতিকে গুলি করার অপরাধে এ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি গ্রেপ্তারও হয়নি।
গত পাঁচ দশকে দেশে হাতির সংখ্যা ৪৫০ থেকে কমতে কমতে নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। অথচ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বলছে, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় হাতি মহাগুরুত্বপূর্ণ এক প্রাণী।

হাতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ এইচ এম রায়হান সরকার। তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলের হাতিগুলোর দীর্ঘদিনের অভ্যাস হচ্ছে তারা ঘুরেফিরে বসবাস করে। একটি হাতি একবার হাঁটা শুরু করলে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার হাঁটতে পারে। এটা তাদের অভ্যাস। মিয়ানমার কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখায় বেশ কিছু হাতির মৃত্যু হয়েছে। এখন নতুন দুই বিপদ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। প্রথমত, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘিরে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প হাতির জীবনচক্র এলোমেলো করে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, একের পর এক হাতি হত্যা করা হচ্ছে গুলি করে।’
এ ব্যাপারে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের আট হাজার একর বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তে মাইন পুঁতে হাতি হত্যা করছে। বাংলাদেশেও গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েকটি হাতি মারা গেছে। এসব হাতিকে কারা, কেন গুলি করেছে, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। গুলিবিদ্ধ হাতির মৃত্যুর ঘটনায় কোথাও কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি খবর নিয়ে জানাতে হবে।’
নির্মমতায় কমছে হাতি :বন বিভাগের জরিপ বলছে, স্বাধীনতার সময় দেশে বন্যহাতির সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৫০টি। কিন্তু ২০০০ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে বন্যহাতির সংখ্যা ২৩৯টি। আবার ২০০৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) জরিপ মতে, দেশে ২২৭টি হাতি রয়েছে। এদিকে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ তাদের জরিপে দাবি করেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ২৭০ থেকে ৩২০টি হাতি আছে। এই হাতির ৭০ শতাংশই চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন অংশে বসবাস করছে। এ সংস্থার হিসাবে সবচেয়ে বেশি হাতি আছে কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বিভাগে। এদের সংখ্যা ৮২ থেকে ৯৩। বান্দরবানে আছে ৪০ থেকে ৪৫টি হাতি। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনাঞ্চলে হাতি আছে ৩০ থেকে ৩৫টি। রাঙামাটির উত্তর বন বিভাগে ৭ থেকে ৯টি এবং দক্ষিণ
বন বিভাগে ৩০ থেকে ৩৫টি হাতি রয়েছে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করে এমন হাতির সংখ্যা প্রায় ১০০টি বলে ধারণা করেছে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
হাতির পুরোনো বিপদ মিয়ানমারের মাইন :সীমান্তে মিয়ানমার মাইন পুঁতে রাখায় গত এক দশকে মারা গেছে বেশ কিছু হাতি। ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা এলাকার একটি মৎস্য প্রকল্পের পানির মধ্যে থেকে হাতির একটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এটি মাইন বিস্ম্ফোরণে গুরুতর আহত হয়েছিল।
এর ১১ দিন পর ১৬ নভেম্বর উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারী এলাকার দুর্গম পাহাড়ি চাককাটার ঝিরিতে গুরুতর আহত আরেকটি হাতির মৃতদেহ পাওয়া যায়। ৩০ নভেম্বর উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারী এলাকার দুর্গম পাহাড়ের ইসকাটার ঝিরির হরিরঞ্জনের রাবার বাগানের পাশে আরও একটি হাতির মৃতদেহ পাওয়া যায়।
এর আগে লামা উপজেলার রহমত উল্যাহর রাবার বাগান থেকে একটি, গজালিয়া ইউনিয়নের হাইমারা ঝিরি থেকে একটি, ইয়াংছা এলাকার সেলিমুল হক চৌধুরীর বাগান থেকে একটি হাতির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি রেঞ্জের আশাতলী বিজিবি ক্যাম্প এলাকার পাশে দুই দেশের নোম্যানস ল্যান্ড বা সীমান্ত শূন্যরেখায় মাইন বিস্ম্ফোরণে এসব হাতি আহত হয় বলে ধারণা করা হয়। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের চাকঢালা, আষাঢ়তলী সীমান্তের ৪৮ নম্বর পিলারের কাছে নোম্যান্স ল্যান্ডে মিয়ানমারের পুঁতে রাখা স্থলমাইন বিস্ম্ফোরণে আরেকটি হাতির মৃত্যু হয় মাস কয়েক আগে।
হাতির নতুন বিপদ গুলি :বাংলাদেশে একের পর এক হাতি মারা যাচ্ছে গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। চলতি বছরের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া এলাকার চাকফিরানির গ্রামের একটি বিলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একটি হাতি মারা গেছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুনাইদ জানান, কুমিরাঘোনা এলাকার চাকফিরানী দক্ষিণের ঘোনা বোইন্না বিলে ধানক্ষেতের পাশে বন্যহাতিটির মৃতদেহ পড়েছিল। খবর পেয়ে তারা বন বিভাগকে জানান। এই হাতির গায়ে গুলির চিহ্ন ছিল। গুলি করা স্থানে পচনও ধরেছিল। তবে এই ঘটনাতেও থানায় কোনো মামলা হয়নি।
লোহাগাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাকের হোসেন বলেন, ‘বন্যহাতির মৃত্যুর ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন এক বন কর্মকর্তা। তবে কোনো মামলা হয়নি। হাতিটি কেন মারা গেছে তা আমাদের জানা নেই।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই স্থানে গুলিবিদ্ধ আরেকটি হাতি মারা গেছে বছরখানেক আগে। ওই ঘটনাতেও থানায় কোনো মামলা হয়নি। কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তেও গত দুই বছরে অন্তত চারটি হাতি মারা গেছে গুলি লেগে। এসব ঘটনাতেও গ্রেপ্তার হয়নি কেউ। রাঙামাটি ও বান্দরবান সীমান্তেও পাওয়া গেছে গুলিবিদ্ধ একাধিক হাতি। কারা এসব হাতিকে গুলি করেছে, তা জানা যায়নি এখানেও।
হাতির জন্য ভয়ংকর ১৫ পয়েন্ট :গুলি করে হাতি হত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৫টি পয়েন্টে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাঁশাখালীর বৈলছড়ি ও অইব্যারখিল বনাঞ্চল, চকরিয়ার ফুলছড়ির রাজঘাট, দুর্গম পান্ডাছড়ি, কাইস্যারঘোনা ও গোয়ালিয়া পালং, ঈদগড়ের ভোমরিয়াঘোনা, উখিয়া, টেকনাফের হ্নীলা, হোয়াইক্যং, লামার ফাঁসিয়াখালীর কুমারী ও ফাঁসিয়াখালী ইত্যাদি।
গত ১৩ জুন চকরিয়া-লামা সীমান্তের লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি খালখুইল্যাখোলার একটি পাহাড়ি ঝিরিতে বন্যহাতির মৃতদেহ পড়ে থাকার খোঁজ পায় বন বিভাগ। হাতিটিকে গুলি করার পর আবার বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদে ফেলা হয়। হাতিটির শরীরজুড়ে ছিল বৈদ্যুতিক শকের দাগ।
এছাড়া কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন চকরিয়ার ফুলছড়ি রেঞ্জের চারটি স্থানে চারটি হাতি, কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের ঈদগড়ের ভোমরিয়াঘোনায় একটি, উখিয়ায় একটি, টেকনাফের হ্নীলায় একটি, হোয়াইক্যংয়ে একটি, বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারী, ফাঁসিয়াখালীতে তিনটিসহ মোট ১৫টি হাতিকে খুন করা হয়।
গত ১২ জুন টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের পশ্চিম পানখালীর খন্ডাকাটা এলাকায় ৩৫ বছর বয়সী একটি হাতিকে হত্যা করা হয়। এটির ওজন আনুমানিক সাতশ’ কেজি। এটির মাথার দিকে গুলির চিহ্ন ছিল। আবার শুঁড়ের ভেন্টাল রিজিয়নে কালো দাগ ছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে গুলির পর বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হাতিটি হত্যা করা হয় বলে উল্লেখ করা আছে। ১২ জুন বাঁশখালীর বৈলছড়ি ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকা অইব্যারখিলে একটি বন্যহাতির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এটিকেও হত্যা করা হয় গুলি করে।
কারা কেন গুলি করছে হাতিকে :হাতিকে কারা গুলি করছে, তা এখনও রহস্যাবৃত ঘটনা। তবে গুলি করার সম্ভাব্য কয়েকটি কারণের কথা জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আমার ধারণা বনাঞ্চল ও আশপাশের জনবসতি রক্ষা, নিজেদের ধানক্ষেত ও বিভিন্ন ফলদ বাগান রক্ষা করতেই বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ বসিয়ে হাতিকে হত্যা করা হচ্ছে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে কেউ কেউ করছেন গুলি। প্রকৃতির বন্ধু হাতির ওপর যারা এমন বর্বর আচরণ করছেন, তারা সুস্থ প্রকৃতির মানুষ নন। বন বিভাগের উচিত, তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।’

পাঠকের মতামত

খেলাভিত্তিক শিক্ষায় ব্র্যাকের তথ্য বিনিময় অনুষ্ঠান

শিশুদের খেলাভিত্তিক শেখা, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ও মনোসামাজিক বিকাশ নিশ্চিতে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো ...

১২ ফেব্রুয়ারি ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনুমতি ছাড়া ওয়াজ মাহফিল নিষিদ্ধ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ধর্মীয় প্রচার কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ...

জামিন বাতিল, মহেশখালীর তোফায়েল হত্যা মামলায় ৭ জন কারাগারে

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়ার মোহাম্মদ শাহ ঘোনা গ্রামের বাসিন্দা জুলাই অভ্যুথানে নিহত শহীদ তানভীর ছিদ্দিকীর ...

ফেসবুক পোস্ট দিয়ে ছাত্রশক্তি নেত্রীর পদত্যাগ‘জুলাইয়ে থানার বাইক চোরের কাছে অনেক সময় হেরে যাই’

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সহযোগী সংগঠন জাতীয় ছাত্রশক্তি কক্সবাজার জেলা শাখার সদ্য ঘোষিত নতুন কমিটি’র ...