
ডেস্ক-
বনানীর রেইট্রি হোটেলে ধর্ষণের শিকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে ধর্ষক সাফাতের অন্তরঙ্গ কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছে একটি চক্র। সামাজিকভাবে হেয় করতেই এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী দুই তরুণী।
এ নিয়ে দুই ছাত্রী বলেছেন, তাদের সামাজিকভাবে হেয় করার পাশাপাশি মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব ছবি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। যেসব ছবি দুর্বৃত্তরা ছড়িয়ে দিচ্ছে তার মধ্যে অনেক ছবি তাদের নয়। ফটোশপে কারসাজি করে এসব বানানো। এ নিয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে মামলা করার কথা ভাবছেন তারা। আর পুলিশ বলছে, যারা এ ধরনের কাজ করছে তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। এদিকে রিমান্ডের প্রথম দিন নাঈম আশরাফ ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন।
ধর্ষণ মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আসমা সিদ্দিকা মিলি বলেন, যারা দুই তরুণীর ছবি ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভুক্তভোগী এক তরুণী জানান, ছবি বিকৃত করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিকভাবে হেয় করা, সম্মানহানির চেষ্টা করা। আরেকটি উদ্দেশ্য হল মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়া। কারা এ কাজ করছে এবং এর উদ্দেশ্য কী এটা সবাই বোঝে। নানাভাবে হুমকি দিয়ে কাজ না হওয়ায় একটি চক্র এ কাজ করছে। আমরা এখন আইনের আশ্রয় নেব।
ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, সেদিন রাতে, আগে ও পরে কী কী করেছেন, আরও অনেক ছবি পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে ধর্ষিত এক ছাত্রী বলেন, ফেসবুকে কে বা কারা আপত্তিকর ছবি প্রকাশ করছে, কারা কোন স্বার্থে এসব ছবি জোগান দিয়ে সহযোগিতা করছে তা তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে। এ কারণেই আমরা আইনের আশ্রয় নেয়ার বিষয়টি চিন্তা করছি।
এদিকে ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদের মোবাইল ফোন থেকে ধর্ষণের ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, দুই তরুণীকে মাঝখানে পার্টিশন দেয়া দুই রুমে ধর্ষণ করা হয়েছিল। পার্টিশনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন নিজের স্মার্টফোন দিয়ে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে বলে স্বীকার করেছে। পরে ভিডিও ক্লিপটি সে শেয়ারইটের মাধ্যমে সাফাতকে দেয়। সাফাত গ্রেফতার হওয়ার আগে ভিডিও ক্লিপটি তার ফোন থেকে মুছে দিয়েছিল। গোয়েন্দারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাফাতের মোবাইল ফোন থেকে ভিডিও ক্লিপটি উদ্ধার করেছেন।
এ ঘটনায় সাফাতের বিরুদ্ধে বনানী থানায় আইসিটি অ্যাক্টে একটি মামলা দায়ের করবেন দুই অভিযোগকারীর একজন। ভিডিও ফুটেজে ধর্ষণের দৃশ্য আছে কিনা-এ ব্যাপারে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তাই মুখ খোলেনি। তবে সাফাতের মোবাইল ফোন থেকে দুই অভিযোগকারীর সঙ্গে সেলফি তোলা অনেক ছবি উদ্ধার করেছে।
সাফাতের মোবাইল ফোন থেকে ভিডিও ফুটেজ উদ্ধারের খবর জানিয়ে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গাড়ি চালক বিল্লাল দ্য রেইনট্রি হোটেলের ৭০১ নম্বর কক্ষের বাথরুম থেকে মোবাইল ফোন দিয়ে ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে। বাথরুমের দেয়ালের কাঁচের রুমের দিক থেকে কিছুই দেখা যাবে না। কিন্তু বাথরুম থেকে দেয়ালের কাঁচ দিয়ে রুমের ভিতরের সব কিছু দেখা যায়। ভিডিও করার পর সাফাত তার মোবাইল ফোনে ঐ ফুটেজ নিয়ে নেয়।
ঘটনার কয়েকদিন পর সাফাত তার দেহরক্ষী রহমত আলীকে ঐ দুই ছাত্রীর বাসায় পাঠিয়েছিলেন। দুই ছাত্রীর পারিবারিক বিষয়ে খোঁজ নেয়ার জন্য সাফাতের নির্দেশে এ কাজ করেছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে রহমত আলী জানান। গাড়ি চালক বিল্লাল এই মামলার চার দিনের রিমান্ডে আছেন। গতকাল তার রিমান্ডের তৃতীয় দিন শেষ হয়েছে। এই মামলায় সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলীর ৩ দিনের রিমান্ড গতকাল শেষ হয়েছে।
অপরদিকে, সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনের মালিকানাধীন দ্য রেইনট্রি হোটেল থেকে উদ্ধার করা সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজের কিছু তথ্য উদঘাটন করা গেছে বলে দাবি করেছেন মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ২৮ মার্চ ধর্ষণের ঘটনার পর ঐ হোটেলে সাফাত, সাকিফ ও নাঈম একাধিকবার যাওয়ার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। উদ্ধার করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই করা হচ্ছে বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এদিকে মামলার এজাহারভুক্ত দুই নম্বর আসামি নাঈম আশরাফের ৭ দিনের রিমান্ডের প্রথম দিন ছিল গতকাল। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় নাঈমের মুখোমুখি করা হয় সাফাতের গাড়ি চালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী রহমত আলীকে।
নাঈমের সঙ্গে একাধিক নারীর অনৈতিক সম্পর্কের তথ্য দিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় সেখানে উপস্থিত ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, নাঈম আসলে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর তরুণীদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পেশাদার দালাল। গুলশান ও বনানী এলাকার উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বখে যাওয়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ইয়াবা সরবরাহ করতেন। ইয়াবা সরবরাহ করেই তিনি এই সোসাইটির খুব কাছে চলে যান। জিজ্ঞাসাবাদের সময় নাঈমের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, সাফাতের সঙ্গে তার কিভাবে পরিচয় হয়েছে।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় সেখানে উপস্থিত ডিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, বিল্লাল আগেই দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনার বিস্তারিত জানিয়েছেন। নাঈমের সামনে ফের একই ধরনের বক্তব্য দেন। এ সময় নাঈমের কাছে জানতে চাওয়া হয় বিল্লাল যা বলছে তা ঠিক কিনা, তখন নাঈম ‘ঠিক’ বলে সম্মত দেয়ে। সেই সঙ্গে নাঈম এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন।
অপরদিকে, বনানী থানার ওসির কর্তব্যে অবহেলা ও আসামিদের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি আরো দুই-তিন দিন পর রিপোর্ট জমা দেবে পুলিশ কমিশনারের কাছে। কমিটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপারেশন অ্যান্ড ক্রাইম) মিজানুর রহমান।
ইতিমধ্যে কমিটি বনানী থানার ওসি ফরমান আলীকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এই কমিটিও অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। এর মধ্যে একটি কমিটি মামলা নিতে গড়িমসি, প্রাথমিক তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ পেয়ে বনানী থানার ওসি ফরমান আলীকে কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। বনানী থানার ওসি অভিযোগের মৌখিক ও লিখিত জবাব দিয়েছেন তদন্ত কমিটিকে।
পাঠকের মতামত