উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১/০৭/২০২৫ ৯:০৬ এএম

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কক্সবাজার জেলায় অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে বড় ধরনের ধস নেমেছে। পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা—দুটোই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। জেলায় পাসের গড় হার ৭০.৭৬ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত বছরের তুলনায় ১২.৮৮ শতাংশ কম। সেই সঙ্গে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে ১১১ জন।

পরীক্ষার ফলাফলের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০ হাজার ২৫৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৪ হাজার ৩৩৩ জন পাস করেছে। জেলায় মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ১৯০ জন শিক্ষার্থী।

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর ১১ হাজার ৮৩৩ জন ছাত্রী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৮ হাজার ২৬৭ জন পাস করেছে। ছাত্রীদের পাসের হার ৭০.৪৩ শতাংশ এবং এদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬০২ জন।

অন্যদিকে, ৮ হাজার ৫৪৯ জন ছাত্রের মধ্যে ৬ হাজার ৬৬ জন পাস করেছে। ছাত্রদের পাসের হার ৭১.২২ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫৮৮ জন।

ফলাফলে বরাবরের মতো এবারও বিজ্ঞান বিভাগ এগিয়ে রয়েছে। ১ হাজার ১৯০ জন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ হাজার ১০৭ জনই বিজ্ঞান বিভাগের।

ফলের দিক থেকে কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৩৩ জন) ও কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (১২৫ জন) জিপিএ-৫ প্রাপ্তির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। তবে জেলার অনেক খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ফল বিপর্যয় দেখা গেছে।

এক সময়ের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কক্সবাজার মডেল হাই স্কুলের ফল এ বছর তুলনামূলকভাবে খারাপ হয়েছে। ২০২৫ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে ২৫২ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে ২২০ জন পাস করেছে, ৩২ জন ফেল করেছে। পাসের হার ৮৭.৩০% এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ১৬ জন। অথচ গত তিন বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানের পাসের হার প্রায় ৯৮ শতাংশ ছিল। ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৯৭.৪৯% এবং জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২১ জন। এছাড়া, ২০২৩ ও ২০২২ সালে যথাক্রমে ২৫ ও ৩৬ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল।

ফলাফল প্রকাশের পর কক্সবাজারের শিক্ষা মহলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়াকে অনেকে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, শিক্ষক সংকট, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও বিদ্যালয়ভিত্তিক দলাদলির ফল হিসেবে দেখছেন।

অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কক্সবাজার মডেল হাই স্কুলসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ক্লাসে শিক্ষকদের গাফিলতি, অনুপস্থিতি ও শৃঙ্খলার অভাবের কারণে এমন বিপর্যয় হয়েছে।

কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অনিয়মিত। মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি, টিউশন নির্ভরতা এবং অবহেলার কারণে তারা স্কুলে ঠিকমতো আসছে না। এতে শিক্ষার পরিবেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং শৃঙ্খলাও ভেঙে গেছে।

কক্সবাজার বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া একাডেমির একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, শুধু শিক্ষার্থী নয়, অনেক শিক্ষকও এখন দায়িত্বজ্ঞানহীন। বিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে না, অথচ অভিভাবকরা এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারছেন না। অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে সমন্বয় একেবারেই ভেঙে পড়েছে।

অভিভাবকদের অভিযোগ, স্কুলের প্রধান শিক্ষককে সরিয়ে দেওয়ার জন্য গত বছর কিছু শিক্ষক, প্রাক্তন ছাত্র ও বহিরাগতদের দিয়ে আন্দোলন করানো হয়েছিল। বর্তমানে একজন বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই সুযোগে কিছু শিক্ষক ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রাক্তন ছাত্র জানান, স্কুলে এখন পড়াশোনার পরিবেশ নেই। ক্লাস হয় ইচ্ছামতো, এমনকি ডিজিটাল হাজিরা ব্যবস্থাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আগে স্কুলে কেউ অনুপস্থিত থাকলে অভিভাবকদের কাছে এসএমএস যেত। এখন স্কুল চলাকালীন অনেক ছাত্রকে ঝাউবাগান বা সমুদ্র পাড়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়।

অভিভাবক ইছমত আরা জানান, স্কুলের ওয়াশরুমে সিগারেট খাওয়া ও ছুরি নিয়ে মারামারির মতো ঘটনা ঘটছে, যা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরেক অভিভাবক মো. শফিকুল ইসলাম জানান, স্কুলে ডিজিটাল হাজিরা বন্ধ, শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন এবং ছাত্রদের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব দেখা দিয়েছে।

ঈদগাঁওর একজন শিক্ষিকা বলেন, জিপিএ-৫ কমে যাওয়া মানে শুধু নম্বর কম পাওয়া নয়, এটি আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার মান নিয়ে প্রশ্ন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রামু ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল ও বদিউল আলম স্মৃতি বিদ্যাপীঠের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান শতভাগ পাস করেছে। অন্যদিকে, অনেক বিদ্যালয়ে পাসের হার ৬০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় সর্বোচ্চ ১৪টি জিপিএ-৫ পেয়েছে, যেখানে পাসের হার ৭৫.৩৫%। ঈদগাহ জাহানারা ইসলাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পাসের হারে শীর্ষে রয়েছে, যেখানে পাসের হার ৯০.৯১%।

পোকখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, দ্বীপশিখা একাডেমি, সাইমম সারোয়ার কমল উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পাসের হার ৬০ শতাংশের নিচে এবং জিপিএ-৫ এর সংখ্যা শূন্য।

শিক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, ফলাফলের এই নিম্নমুখী চিত্র প্রশাসনিক দায়িত্বহীনতা, রাজনীতি প্রভাবিত নিয়োগ ও দুর্বল তদারকির ফল।

রামুর একজন প্রধান শিক্ষক বলেন, শিক্ষকদের মধ্যে উৎসাহ নেই, শিক্ষার্থীরা লক্ষ্যহীন এবং অভিভাবকরা অসহায়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ, কঠোর নজরদারি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা প্রয়োজন।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজারের এবারের ফলাফল হতাশাজনক। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, স্কুলে ডিজিটাল হাজিরা পুনরায় চালু, শৃঙ্খলা রক্ষায় অভিভাবক ও প্রশাসনের সমন্বয়, শিক্ষক মূল্যায়ন ও জবাবদিহিতা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য মনিটরিং সেল তৈরি করা গেলে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

সুত্র,বিডিটোয়েন্টিফোর লাইভ ডটকম

পাঠকের মতামত

এইচএসসির স্থগিত ২২ ও ২৪ জুলাইয়ের পরীক্ষা একই দিনে: শিক্ষা উপদেষ্টা

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় স্থগিত হওয়া এইচএসসি ও সমমানের দুটি ...

মঙ্গলবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত, তথ্য উপদেষ্টার মধ্যরাতের ঘোষণা

মঙ্গলবার (২২ জুলাই) অনুষ্ঠিতব্য এইচএসসি (উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। মধ্যরাতে এ ...

স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি থেকে বাদ যাচ্ছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা

স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। এ পদে সরকারি কর্মকর্তাদের যুক্ত করার ...