ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ২২/১০/২০২৫ ৮:৪৬ এএম

আইন, প্রযুক্তি ও সচেতনতা ছাড়া জুয়া বন্ধ অসম্ভব
বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া এখন আর শুধু বিনোদন বা নেশা নয় এটি একটি গোপন অর্থপাচারের চক্রে পরিণত হয়েছে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) যেমন বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায় ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে।

সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা উদ্বেগজনক। মাত্র তিন মাসের মধ্যে ৪ হাজারেরও বেশি এমএফএস অ্যাকাউন্ট অনলাইন জুয়া সংক্রান্ত কার্যক্রমের কারণে স্থগিত বা বাতিল করা হয়েছে।

অর্থপাচার দেশে নতুন কিছু নয়। কিন্তু অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে এর ধারা আরও সূক্ষ্ম ও জটিল হয়েছে। বিএফআইইউ ও সিআইডির তদন্তে দেখা গেছে চক্রটি মূলত ফেসবুক, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউবের মাধ্যমে জুয়ার লিংক ছড়ায়। খেলোয়াড়দের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের জন্য তারা নকল বিকাশ বা নগদ নম্বর ব্যবহার করে, যেগুলো সাধারণত ভুয়া এনআইডি দিয়ে খোলা।

এরপর সেই টাকা, প্রথমে ছোট অঙ্কে কয়েকটি ‘রুট’ অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়, পরে ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ বা আন্তর্জাতিক গেমিং প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তর করা হয় এবং শেষ ধাপে বিদেশে থাকা সহযোগীদের অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যায়।

অর্থাৎ, দেশের ভেতরের জুয়াড়ি নিজের অজান্তেই একটি অর্থপাচার চেইনের অংশে পরিণত হয়।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সূত্রে জানা গেছে, গত জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে অন্তত ১২০টি অনলাইন জুয়া ও বেটিং সাইট শনাক্ত করা হয়েছে। এসব সাইটের সঙ্গে যুক্ত ৪ হাজার এমএফএস অ্যাকাউন্ট বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রায় ৩০ কোটি টাকার লেনদেন সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার একটি বড় অংশ গিয়েছে বিদেশি সার্ভারে।

ডিবি ও র‍্যাব যৌথভাবে বেশকিছু অভিযানও চালিয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেট থেকে একাধিক জুয়া সাইটের লোকাল এজেন্ট গ্রেপ্তার হয়েছে। তারা স্বীকার করেছে, প্রতিদিন কয়েক হাজার ব্যবহারকারী এই অবৈধ জুয়া খেলায় অংশ নিচ্ছেন এবং একজন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে।

অনলাইন জুয়া কেবল ব্যক্তির আর্থিক ক্ষতি ঘটাচ্ছে না, বরং রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকেও বিপন্ন করছে।

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এই পাচার হওয়া টাকা অবৈধভাবে বিদেশি মুদ্রা বাজারে চাপ সৃষ্টি করছে।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, প্রতিমাসে অনলাইন জুয়া ও বেটিং সাইটের মাধ্যমে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে যা রেমিট্যান্স প্রবাহের বিপরীতে এক ধরনের ছিদ্র তৈরি করছে।

এছাড়া, সামাজিক দিক থেকে তরুণ সমাজে এর প্রভাব ভয়াবহ। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় স্কুল–কলেজ পড়ুয়া তরুণরা এখন জুয়া সাইটে আসক্ত হচ্ছে।

শিক্ষা, পরিবার ও মানসিক স্বাস্থ্যে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিপদ সংকেত।

বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং বা এমএফএস মূলত আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর লক্ষ্যেই চালু হয়েছিল। কিন্তু অপরাধীচক্র এখন এই সেবাকে ব্যবহার করছে পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে।

বিএফআইইউর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক এমএফএস এজেন্ট আসলে এই জুয়া চক্রের সঙ্গে জড়িত তারা কমিশনের বিনিময়ে ভুয়া একাউন্ট খুলে দেয় এবং লেনদেন সীমা এড়াতে ছোট ছোট অঙ্কে বড় লেনদেন ভাগ করে ফেলে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সিনিয়র কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি একজন জুয়াড়ির অ্যাকাউন্টে দিনে ৫০–৬০টি লেনদেন হচ্ছে। কিন্তু সেগুলোর উৎস বা উদ্দেশ্য কেউ জানে না।’

সাইবার অপরাধ দমনে দেশে ইতিমধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন কার্যকর আছে।

কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, অনলাইন জুয়া ঠেকাতে এই আইনগুলোতে আরও নির্দিষ্ট ধারা ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা প্রয়োজন।

প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, দেশীয় এমএফএস কোম্পানিগুলোকে রিয়েল টাইম ট্রানজেকশন অ্যালার্ট সিস্টেম চালু করতে হবে, ভুয়া এনআইডি যাচাইয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাবেসের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন জরুরি এবং আন্তর্জাতিক মানের অ্যান্টিমানি লন্ডারিং (এএমএল) সফটওয়্যার প্রয়োগ করতে হবে।

বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, “জুয়া সাইটগুলো সার্ভার পরিবর্তন করে বা ভিপিএন ব্যবহার করে দেশের আইপি এড়িয়ে যায়। তাই কেবল অভিযানে নয়, প্রযুক্তিতেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।”

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় ও ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ যৌথভাবে “অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে করণীয়” শীর্ষক এক সভা করে। সভায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সিদ্ধান্তগুলো হলো, দেশে জুয়া বা বেটিং সাইটে অর্থপ্রবাহ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হবে, এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাকাউন্ট মনিটরিং করতে হবে এবং টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলোকে এসব সাইটে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিএফআইইউর এক সদস্য বলেন, “অনলাইন জুয়া এখন কেবল নৈতিক অপরাধ নয় এটি অর্থপাচার, মাদক, এমনকি সন্ত্রাসী অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত। তাই এটি রোধে সব সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।”

উল্লেখ্য, অনলাইন জুয়া বাংলাদেশের সমাজে নতুন এক অন্ধকার দিগন্ত খুলে দিয়েছে যেখানে বিনোদনের নামে ধ্বংস হচ্ছে ব্যক্তি, পরিবার ও অর্থনীতি। অর্থপাচারের এই গোপন রুট বন্ধ করতে হলে কেবল অভিযান নয়, লাগবে প্রযুক্তি, নীতি ও সচেতনতার ত্রিমাত্রিক ব্যবস্থা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোরতা, এমএফএস খাতের জবাবদিহিতা এবং জনগণের সচেতনতা এই তিন শক্তিই পারে দেশকে এই অনলাইন জুয়ার ছোবল থেকে রক্ষা করতে।

পাঠকের মতামত

পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ আজ

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে আজ রোববার (৭ সেপ্টেম্বর)। শনিবার (৬ ...

১০০০০ মিলিঅ্যাম্পিয়ারের বেশি সক্ষমতার ব্যাটারি নিয়ে আসছে রিয়েলমি

তরুণদের পছন্দের স্মার্টফোন ব্র্যান্ড রিয়েলমির মাইলফলকে যুক্ত হতে যাচ্ছে আরও একটি অসাধারণ অর্জন। উদ্ভাবনের প্রতি ...