প্রকাশিত: ২২/০১/২০২১ ৯:৩৩ এএম , আপডেট: ২৮/০১/২০২১ ১১:৫০ এএম

ওবাইদুল হক চৌধুরী, উখিয়া নিউজ ডটকম::
“প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে লম্বাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। গাছপালা কেটে উপরে একটি ছাউনি দিয়ে কোন রকম রাত কাটানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু সূর্য উঠার পরে ওই ছাউনির তলে আর টিকে থাকতে পারলাম না। প্রচন্ড গরমে ছেলে মেয়ে গুলো ছটপট করতে লাগল। ভাত রান্না করার জন্য আমার স্ত্রী রহিমা চুলোই আগুন দিয়ে বলেছিল ‘এভাবে জীবন কাঠানো যাবে না, এখানে গাছ রোপন করতে হবে’৷ কথাগুলো রহিমা তার স্বামী দিল মোহাম্মদকে বলছিলেন ।

লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বন উজার করে আশ্রয় দেয়ার তিন বছরের ব্যবধানে ইউএনএইচসিআর, ডাব্লিউএফফি ও আইওমসহ অনেক দাতা সংস্থা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বৃক্ষ রোপন কাজে যুক্ত আছে।

আন্তর্জাতিক এনজিও গুলোর সহায়তায় সবুজ ফিরছে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে। রোহিঙ্গাদের অনেকেই এখন বলছেন, যদি জানতাম গাছপালার জন্য পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে আর গাছ থাকলে ক্যাম্পে শান্তির সু-বাতাস বইবে, তাহলে গাছপালা কাটতাম না।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উখিয়া টেকনাফে ৮ হাজার ১৬৩ একর বনভূমি রোহিঙ্গারা উজাড় করেছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গারা জ্বালানি মেটাতে ৪ হাজার ২৭ একর সৃজিত বনভূমি ধ্বংস করেছে। আর বসতি স্থাপন করতে গিয়ে ৪ হাজার ১৩৬ একর প্রাকৃতিক বন ন্যাড়া করেছে। ন্যাড়া বনগুলো ফিরিয়ে আনতে সরকারের নির্দেশে এনজিওগুলো বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়ে গাছ রোপনে রোহিঙ্গাদের উৎসাহিত করছে।

সম্প্রতি মধুরছড়া, লম্বাশিয়া ঘুরে দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের বাড়ির আনাচে কানাচে বেড়ে উঠছে ফলজ, বনজ ও ওষুধি গাছ। একটি রোহিঙ্গা ক্যম্পের বাসিন্দা আবদুল বাসির (২৮) জানান, “এখন প্রকৃতির আশীর্বাদ পাচ্ছি আমরা। গত তিন বছরে আমরা প্রচন্ড তাপমাত্রায় যা কষ্ট পেয়েছি এখন তা আর মনে পড়ে না। মনে হয় যেন সরকারের হাতে গড়া একটি পর্যটন পরিবেশ।”

বাসির আরো জানান, আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থাগুলো ক্যাম্পের ঘরগুলোর আনাচে কানাচে গাছ লাগিয়েছে৷ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করায় গাছগুলো দ্রুত বেড়ে উঠেছে, ছায়া দিচ্ছে এরই মধ্যে। এখন রোহিঙ্গারা উপলদ্ধি করতে পারছে পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ৷

একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হেড মাঝি আব্দুল হাই বলেন, আগে আমরা গরমে নিঃশ্বাস ফেলতে পারিনি এবং নিতেও পারিনি। এখন পরিবেশ উন্নয়নের ফলে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। তিনি বলেন, পরিবেশের উন্নতি হবার কারণে ক্যাম্পের অধিবাসীদের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা কমে গেছে। ঘরে ঘরে সবাই উৎসাহিত হচ্ছে যেন ক্যাম্পের এক ইঞ্চি জায়গাও খালি না থাকে, গাছ যেন সর্বত্র লাগানো হয়। রোহিঙ্গারা না থাকলেও তাদের রোপন করা গাছগুলো রোহিঙ্গাদের স্মৃতি হয়ে থাকবে।

আব্দুল হাই বলেন, গাছ উন্নয়নের নেপথ্যে এনজিও সংস্থাগুলোর অবদান অস্বীকার করা যায় না। কেননা তারা যদি ঘরে ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ না করতো তা হলে রোপন করা গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে রান্নার কাজ করতো রোহিঙ্গারা। তাহলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন করা কঠিন হতো। কারণ রান্নার জন্য কাঠের দরকার পরলে রোহিঙ্গাদের কাছে গাছের কদর প্রত্যাশা করা অবান্তর হতো।

প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করছেন এনজিও সংস্থা সুশীলনের সিনিয়র ফরেষ্ট অফিসার মোঃ ফারহান হক৷ এই প্রতিবেদককে বলেন, তিনি কাজ করছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে৷ যেন জীববৈচিত্র্য ও পাখির কল কাকলিতে মুখরিত হয় ক্যাম্পগুলো। জানান, যেখানে থাকার ব্যবস্থা নেই ওই জায়গাগুলোতে প্লট আকারে গাছ রোপন করা হচ্ছে। প্রায় শতাধিক প্লটে এক কোটির বেশি গাছের চারা রোপন করা হয়েছে। চারাগুলো রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। যেন সেগুলো তাদের বাড়ির আঙ্গিনায় বা ক্যম্পের ফাঁকা জায়গায় রোপন করে ক্যাম্পের পরিবেশ পরিবর্তন করতে পারে। তিনি বলেন, যেভাবে ক্যাম্পে সবুজ ফেরাতে চেষ্টা করা হচ্ছে, তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ক্যাম্পগুলো হবে সবুজে ঘেরা আবাসস্থল।

একজন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জ হাফিজুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গাছ পালা বেড়ে উঠার কারণে ক্যাম্পের পরিবেশের আমূল পরিবর্তন এসেছে। ক্যাম্পে হেটে এখন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তিনি বলেন, ক্যাম্পে গাছ রোপনের জন্য রোহিঙ্গাদেরকে অনেক বোঝাতে হয়েছে। যাকে যেভাবে পেরেছেন সেভাবে বুঝিয়ে গাছ লাগাতে সহায়তা করেছেন। যে কারণে আজ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোত এখন সবুজের সমারোহ ঘটছে।

উখিয়া উপজেলার একজন কর্মকর্তা শফিউল আলম বলেন, এনজিও সংস্থার সহায়তায় রোহিঙ্গাদের সামগ্রিক উদ্যোগে ক্যাম্পগুলোতে সবুজায়ন হতে শুরু করেছে। এটা জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের সাড়ে ছয় হাজার একর জায়গার ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। মানবিক কারণে বাংলাদেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও তারা উজাড় করেছে সাড়ে ৪ হাজার ১৩৬ একর বনভূমি। রোহিঙ্গাদের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বনের পশু-পাখি।

পাঠকের মতামত

উখিয়াবাসীর স্বপ্ন পূরণ করতে চাই – জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর বিবৃতি

গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রেক্ষাপটে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে বিবৃতি দিয়েছেন উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ...

ইসলামপুরে আটক রোহিঙ্গা যুবককে কুতুপালং ক্যাম্পে হস্তান্তর

জামালপুরের ইসলামপুরে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার মো. রোবেল (২২) নামের সেই রোহিঙ্গা যুবককে কক্সবাজারের কুতুপালংয়ের ট্রানজিট ...