
সোসাইটি ফর হেলথ এক্সটেনশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট (শেড) বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা কক্সবাজার থেকে গড়ে উঠা একটি জাতীয় পর্যায়ের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা-এনজিও। এই সংগঠটির প্রতিষ্টাতা ছিলেন কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারের সন্তান জনাব মুহাম্মদ উমরা (উমরা মিয়া)।তিনি বার্ধক্য জনিত কারণে গত ৮ আগস্ট ২০২৫ ইংরেজি রোজ শুক্রবার রাত আনুমানিক সাড়ে দশটার সময় উনার কক্সবাজারস্থ বাসায় গুরুতর অসুস্থ হলে উনাকে দ্রুত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স হয়েছিল আনুমানিক আশি বছর।
তিনি তাহার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর শেড সংস্থার নির্বাহী পরিচালক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তাহার একান্ত প্রচেস্টায় সংস্থাটি দেশের সীমানা পেরিয়ে আজ বৈশ্বিক পরিমন্ডলেও ব্যাপক পরিচিত লাভ করেছেন।দাতা সংস্থার কাছেও সংস্থাটি বেশ সমাদৃত।
বর্তমানে সংস্থাটি বিভিন্ন দেশীয়, আন্তর্জাতিক ও জাতিসংঘের অর্থায়নে স্বাস্থ্য,পুষ্টি,ওয়াশ,খাদ্য নিরাপত্তা,পল্লী জীবিকায়ন,দূর্যোগব্যবস্থাপনাসহ বহুমাত্রিক কার্যক্রম পরিচালক করছে।
১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক উদারময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) হাত ধরে উমরা স্যারে নেতৃত্বে এই সংস্থার হাতে কড়ি।
সংস্থার দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে উমরা স্যার আইসিডিডিআরবি’র টেকনাফ স্টেশনে সিনিয়র রিসার্চসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং আইসিডিডিআরবি’র টেকনাফ স্টেশনের কার্যক্রম সমাপ্তিকালে টেকনাফ সীমান্ত এলাকার জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কমিউনিটি বেইজড সংস্থা (সিবিও) হিসাবে শেড’কে প্রতিষ্টা করা হয়।নবসৃষ্ট এই সংস্থার পরিচালনার জন্য ডেপুটেশনে দায়িত্ব দেওয়া হয় উমরা স্যারকে।তখনকার দিনে আইসিডিডিআরবি’তে চাকরি পাওয়া যেমন সুনামের ছিল তেমনি এই সংস্থার চাকরিও ছিল অত্যন্ত লোভনীয়। বিশাল সুযোগ সুবিধা সম্বলিত স্থায়ী চাকরি ছেড়ে নতুন একটি সিবিও’র দায়িত্ব নেওয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন সিদ্ধান্তঃ যা উমরা স্যার অসীম সাহসিকতার সহিত গ্রহন করেছিলেন। টেকনাফ এলাকার তৎকালীন সময়ের একজন মেধাবী সায়েন্স গ্রাজুয়েট হিসাবে মর্যাদাপূর্ন চাকরি ছেড়ে এই সংস্থার দায়িত্ব নিলেন কেবল এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সেবা করার মানসে।
উনার কাছ থেকে শোনেছি সংস্থার শুরুর দিকে সংস্থার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলনা।ফলে কখনো কখনো মাস শেষে সংস্থায কর্মরত স্টাফদের বেতন ভাতা দিতে গিয়ে উনাকে বেশ চ্যালেন্জের মুখে পড়তে হতো এবং উনি উনার ব্যবসায়ি পিতা জনাব মরহুম নজির আহমদ সওদাগরের কাছ থেকে টাকা ধার করে স্টাফদের মাসিক বেতন পরিশোধ করতেন।পরবর্তীতে উনার শ্রদ্বেয় পিতার মৃত্যরপর টেকনাফের বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে তিনি একইভাবে অর্থ সহযোগিতা নিয়ে সংগঠনের কার্যক্রম সচল রাখতেন।
ব্যক্তি হিসেবে উনি অত্যন্ত বিনয়ী, সজ্জন,সদালাপী ও কর্মীবান্ধব ছিলেন।
আমার সরাসরি সুপারভাইজার হিসাবে কর্মজীবনে উনার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি ও জেনেছি যা আমার সারাজীবনের পাথেয় হিসাবে থাকবে।কক্সবাজার জেলার মানুষের প্রতি উনার অন্যরকম দরদ ছিল।চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সময় উনি কক্সবাজার জেলার স্থানীয় বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দিতেন এবং আমাদেরকেও এই বিষয়ে জোর তাগিদ দিতেন।
উনার আচরণে কোন কর্মী কস্ট পেয়েছেন এমনটা আমরা কখনো শোনিনি।সংস্থায় কর্মরত নিন্ম পর্যায় থেকে উর্ধ্বতন পর্যায় পর্যন্ত সকলে উনার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারতেন এবং যেকোন বিষয় সরাসরি শেয়ার করতে পারতেন।সমাজের অসহায় মানুষের পাশে থাকতেন নিরবে নিবৃতে।উনি অফিসে থাকাকালীন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অসহায় লোকজন উনার কাছে আসতেন এবং উনি সাধ্যমত তাদের সহযোগিতা করতেন।
উনি প্রায় সময় আমাদের বলতেন এবং উনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এই মানবসেবার কারণে আল্লাহ উনাকে জান্নাত দান করবেন।
উনি কক্সবাজার তথা পুরো দেশের কল্যানে যে অবদান রেখেছেন বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায় ও বেকারত্ব দূরিকরণে উনার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিও ছিল উনার অপরিসীম দয়া ও টান।২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে যখন খালি হাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ অংশে আসেন তখন তিনি নিয়মিত তাদের খোঁজখবর রাখতেন এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহযোগিতার পাশাপাশি নিজেও প্রায় সময় সহযোগিতা করতেন।রোহিঙ্গাদের এই মানবেতর জীবনযাপন তাকে বেশ বিচলিত করতেন।
দাতা সংস্থার সদস্যদের প্রতি উনার সম্মান ছিল আকাশ সমান।এমনকি বয়সে উনার চেয়ে অনেক জুনিয়র হলেও তিনি তাদের অত্যন্ত সম্মান করতেন।দাতা সংস্থার কোন সদস্য উনার অফিসে আসলে বিদায় বেলায় নিজে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন অথবা আমাদেরকে দায়িত্ব দিতেন যাতে আমরা তাদেরকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
উনি যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, নেপাল, মায়ানমারসহ বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন।
অবসর সময়ে বই পড়তে পছন্দ করতেন।সুফিজম ও সমকালীন ধর্মতত্ত্বে উনার গভীর জ্ঞানছিল। এনজিও জগতের এই পুরোধা ব্যক্তির মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হলো। উনার ভালো কর্মের মাধ্যমে উনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন সবার মাঝে।
আল্লাহ উনার সমস্ত ভুলত্রুটি ক্ষমা করে উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন।
লেখক,
জিয়াউর রহমান মুকুল,
উপ-পরিচালক,শেড।
পাঠকের মতামত