আমাদের এই ছোট্ট জীবনটার পুরোটাই হচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্র।যত সময় যাচ্ছে, ততই যেন আমরা নতুন বিষয় শিখছি, নতুন বিষয় সম্পর্কে জানছি। এবং পুরাতন ধারণাগুলো ঠেলে নতুন সব ধারণার জন্ম দিচ্ছি । আসলে আমরা জীবনে দুইভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি তার মধ্যে একটি হচ্ছে দেখে শিখা আরেকটা হচ্ছে ঠেকে শিখা।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হিসেবে আমরা যা শিখি তার অন্তত ৮০% বাস্তব জীবনে প্রযোজ্যই হয় না। যেমন, ইতিহাস ক্লাসে শিখানো হয়, ফরাসি বিপ্লব কবে হয়েছিল, কেন ঘটেছিল, সমাজে অন্যায়ের কি প্রভাব পড়ে, এবং আজকের সমাজে আমরা সেখান থেকে কি শিক্ষা নিতে পারি। গণিত ক্লাসে শেখানো হয় জটিল সমীকরণ বা ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে তার চেয়ে বেশি দরকার, কিভাবে নিজের বেতন ম্যানেজ করা যায়, কিভাবে ঋণ না বাড়িয়ে সঞ্চয় বাড়ানো যায়। অর্থাৎ পড়াশোনা হচ্ছে ঠিকই, মধ্যবিত্ত পরিবারেরা তাদের সন্তানের পিছে টাকা ভাঙছে ঠিকই। কিন্তু সেই পড়াশোনার আসল প্রাপ্তি কি!
আমরা কেউ ভুলের অনর্ধ্বে নয়। মানুষ মাত্রই ভুল। জীবনে আসলেই ভুল করার প্রয়োজন আছে, কেননা ভুল করলে আমরা সঠিকটা জানতে পারবো। তা না হলে আমরা কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল তার মধ্যে গুলিয়ে ফেলবো। আপনি নিজের জীবন থেকেই দেখুন না! যে ভুল কাজটি জীবনে একবার করে ফেলেছেন সেটি কখনোই দ্বিতীয় বার করতে নিশ্চয়ই যাবেন না। তবে এই কাজটি যে ভুল সেটি যদি আপনি উপলব্ধি করতে না পারতেন তাহলে নিশ্চয়ই এর কাজটি বারবার করতেন এবং নিজের ক্ষতি হতো। তাই জীবনে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য কিছু ভুল করার প্রয়োজন আছে।অন্য যেকোনো কিছু আমাদের যেভাবে শিক্ষা না দেয়, একটা ভুল আমাদের জীবনের অনেক বড় শিক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।
জীবনে কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময় ভুল সঠিক যাচাই করিনা আমরা। বিখ্যাত বিজ্ঞানী থমাস এডিসন তার কয়েক হাজার বার ব্যর্থতার পর বলেছিলেন, “আমি ব্যর্থ হইনি, আমি সফলভাবে ১০,০০০টি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি যা কাজ করে না।” তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চোখ খুলে দেয়-ভুল করা মানেই ব্যর্থতা নয়, বরং এটি শেখার একটি ধাপ।
মানব জীবনে প্রতিটি ভুল একেকটি সিঁড়ি, যা আমাদের উন্নতির পথে নিয়ে যায়। একটিমাত্র সঠিক সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনে উন্নতি আনতে পারে, কিন্তু প্রতিটি ভুল সিদ্ধান্ত আমাদের আরো গভীর অভিজ্ঞতা দিয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে, একজন শিক্ষার্থীর পরীক্ষা খারাপ হওয়ার পরই সে বুঝতে পারে তার প্রস্তুতিতে কী কী ফাঁক রয়েছে, এবং সেই ভুলের মাধ্যমেই সে পরবর্তী সময়ে আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে।
প্রতিটি মানুষের জন্য অন্তত ৩টি সাধারণ বিষয় জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ -
* কিভাবে মানসিক চাপ সামলাতে হয়।
* প্রতি মাসের আর্থিক অর্জন কিভাবে বাজেট করতে হয়।
* নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির করতে হয়।
ভুলের জন্য নিজেকে বারবার দোষারোপ থেকে ভালো কিছু আসে না, বরং ক্ষতি হয় নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের। অনেকেই অতীতের ভুলের কারণে প্রতিনিয়ত নিজের বর্তমানকে ক্ষতির খাতায় তুলে ফেলেন।
শুধু ভুল স্বীকার করার সাহস হয় না বলেও অনেক সময় আমরা বারবার একই ভুলের মাকড়সা জালে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলি। তাই একটু সাহস করে নিজের ভুল স্বীকার করাটা যেকোনো ভুল শোধরনার প্রাথমিক ধাপ। কিন্তু আশায় তখনই গুড়ে বালি হয়, যখন কেউ মানতেই চায় না ভুলটি তারই ছিল।
ভুলের কারণ বিশ্লেষণের জন্য নিজেকে কিছুটা সময় দিন। একই ভুলের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। ভুলটা যদি হয় ব্যক্তিগত জীবনে, তবে সেটি পেশাদার জীবনের ভুল থেকে অনেকটাই আলাদা। এই ভিন্ন ধরনের ভুলের জন্য বিশ্লেষণটাও হবে সে অনুযায়ী। তাই ভুল করে হলেও নিজের ভুল নিয়ে একটুখানি ভেবে দেখুন, হয়তো প্রশ্নের মধ্যেই পেয়ে যাবেন আকাক্সিক্ষত উত্তরটি।
শিল্প-সাহিত্যে ভুলকে সবসময়ই মানব জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। গ্যেটে তাঁর "ফাউস্ট" কাব্যে ভুল ও প্রলোভনের মধ্য দিয়ে একজন মানুষের নৈতিক বিকাশ দেখিয়েছেন। জীবনেও আমাদের ভুলের মধ্য দিয়ে নিজস্ব নৈতিকতা ও বোধশক্তির বিকাশ ঘটে।
তবে ভুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি আমাদের বিনম্র হতে শেখায়। আমরা যখন বুঝতে পারি যে আমরা ভুল করেছি, তখন আমাদের অহংকার কমে আসে, এবং সেই বিনম্রতা আমাদের জীবনে আরও স্থিতিশীলতা এনে দেয়। ভুলগুলোর ভেতরেই লুকিয়ে আছে আমাদের সেরা শিক্ষাগুলো।
এ কথা সত্যি যে জোরজবরদস্তি করে ভালো কথা ভাবলেও তা খারাপ ফল নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু অনেক সময় নিজেকে নিজেরই আশ্বস্ত করতে হয়। যা হয়েছে, এর চেয়েও বাজে কিছু হতে পারত এবং এই ভুল শুধরে নেওয়ার সময় আছে- এমন নিরীহ সান্ত¡না মাঝে মাঝে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিতে সক্ষম।
আজকের শিক্ষা অনেকটা এরকম-মানুষকে মাছ ধরতে শেখানোর বদলে, মাছের ওজন মুখস্থ করানো হয়। তাই আমাদের উচিত শিক্ষা থেকে মুখস্থ বিদ্যা বাদ দিয়ে এমন কিছু শেখানো, যা বাস্তব জীবনে কাজে লাগবে। যেনো মানুষ শুধু চাকরি নয়, নিজের জীবন নিজেই তৈরি করতে পারবে।
আপনার ভুলগুলোও আপনারই অংশ। তাই সেগুলোকে নিজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন না করে দিয়ে কীভাবে জীবনে চলার পথে তা কাজে লাগিয়ে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যায়, সে বিষয়ে সচেতন হোন। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু আবিষ্কারের গল্প শুরু হয়েছিল কারো না কারো একটি নিছক ভুল থেকে। সুতরাং, ভুল করার পরিণতি থাকলেও, সেগুলো জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। ভুল আমাদের কেবল পথচ্যুত করে না, এটি আমাদের সত্যিকারের পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করে। কেনোনা ভুল ছাড়া আমাদের উন্নতি অসম্ভব।
রেহানা ফেরদৌসী
সহ সম্পাদক, সমাজকল্যাণ বিভাগ,
পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি
(কেন্দ্রীয় পুনাক)
মোহাম্মদপুর, ঢাকা।