প্রকাশিত: ২২/০৩/২০১৮ ১২:৪২ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৫:০৮ এএম

এ এইচ এম সালাহ্ উদ্দিন মাহমুদ::

১৯৬৭ সাল। আমি যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি বীরেন শিকদার।
আমরা কক্সবাজারের লোক এবং স্কুল-কলেজ জীবন কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে, বাবার চাকরির সুবাদে যশোর যাই। যশোরে থাকতে কেন্দ্রীয় নেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শেখ শহিদুল ইসলাম ও নুরে আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। তাঁদের নির্দেশ ও পরামর্শে যশোর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে ছয় দফা প্রচার শুরু করি। প্রচারপত্র নিয়ে স্কুল-কলেজ এবং হাটে হাটেও গিয়েছি, বক্তব্য দিয়েছি।
’৬৯ সালে চলে আসি ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এ সময় আমরা একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন করলাম—জাতীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন (জাসান্দো)। সভাপতি ছিলেন সে সময়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তাঁর পরামর্শে আমরা সাংস্কৃতিক সংগঠনের আড়ালে স্বাধীনতায় বিশ্বাসীদের রিক্রুট করতাম।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দিন মাঠে ছিলাম স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে।
১২ মার্চ সকালের কথা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। আবদুর রাজ্জাকসহ আরো কয়েকজন নেতা আমার হাতে একটি পিস্তল দিলেন। আমাকে বলা হলো, এটা নিয়ে আমাকে খিলগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে যেতে হবে, সেখানে কিছু ছাত্র-তরুণ আসবে। ‘রক্তজবা’ শব্দ উচ্চারণ করলে যদি তারা সাড়া দেয়, বুঝতে হবে তারা আমাদের লোক। তাদেরকে একটি গোপন স্থানে নিয়ে এই পিস্তল ছুঁইয়ে শপথ করাতে হবে। শপথের বাক্যটা ছিল—‘এই অস্ত্র হাতে শপথ করছি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেব। ’ খিলগাঁওয়ে দায়িত্ব পালন করে গেলাম বাসাবো। এভাবে ১৭ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে শপথ পড়ানোর কাজ করলাম।

২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। এ দিন কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাকিস্তানের পতাকার বদলে দেশের সর্বত্র বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হবে। এদিন কক্সবাজারের চকোরিয়ায় জনসভা করে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি নেওয়া হয়। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেই আমি। বিশাল জনসভায় সভাপতিত্ব করেন এস কে শামসুল হুদা। বক্তব্য দিই আমি, এমএনএ এম আর সিদ্দিকী ও ডা. সামসুদ্দিন আহমেদ।

২৬ মার্চ আমি চকোরিয়াতে। সকালেই পুলিশের ওয়্যারলেসে পাকিস্তানি সেনাদের ঢাকা আক্রমণের খবর পাই। দুপুরে খবর আসে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। চট্টগ্রামের জহুর হোসেন চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতা ঘোষণার কপি রাতেই বঙ্গবন্ধু পাঠিয়েছেন। জহুর আহমেদ চৌধুরী সকাল থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার কপি সাইক্লোস্টাইল করে জনগণের মধ্যে বিতরণ ও মাইকিং করছেন। জহুর আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আমরাও মাইকিং করে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করি।

এ ঘটনার দুই দিন পর চট্টগ্রামের কালুরঘাটে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বাঙালি সেনা-ইপিআরের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আহত ক্যাপ্টেন হারুনকে আমরা উখিয়াতে নিয়ে চিকিৎসা করি।

২৯ মার্চ আমরা চকোরিয়া থানা লুট করে অস্ত্রগুলো কবজায় নিই। অস্ত্র লুটের ঘটনায় পুলিশ একটি মামলা দায়ের করে। আসামি করা হয় ডা. সামসুদ্দীন, এস কে শামসুল হুদা, আনোয়ার হাকিম দুলাল, সিরাজুল হক, রাজা মিয়া, মোজ্জাম্মেল হক, আমিসহ মোট ৫৬ জনকে।

২৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা কক্সবাজারে প্রবেশ করলে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। কক্সবাজারের একদিকে সমুদ্র, আরেক দিকে পাহাড়ঘেরা গভীর অরণ্য, অন্যদিকে বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার)। আমরা খবর পাচ্ছিলাম প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যেতে হবে। তবে আমরা ভারতে যেতে পারিনি। কক্সবাজারের কোনো এমএনএ-এমপিএ ও নেতাকর্মী কেউ ভারতে যেতে পারেননি। ২৯ এপ্রিল কক্সবাজারের এমএনএ অ্যাডভোকেট নুর আহমেদ, এমপিএ ওসমান সরোয়ার, আওয়ামী লীগ নেতা মোজাম্মেল হক, আফসার কামাল চৌধুরী, ডা. সামসুদ্দিন, এস কে শামসুল হুদা, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, কামাল হোসেন চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রায় ৩০০ নেতাকর্মী সীমান্ত পেরিয়ে বার্মায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। বার্মা সরকার তাদের আটকে রাখে। তারা ফিরে আসে স্বাধীনতার পরে, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে।

নেতাদের বার্মা সরকার আটকে রাখার খবর পাওয়ার পর আমরা আর বার্মায় যাইনি। আমি এমপিএ অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম, চট্টগ্রামের এমএনএ আতাউর রহমান খান কায়সার, এমপিএ ইসহাক মিয়া চকোরিয়া ও বাঁশখালীর পূর্বদিকের গহিন অরণ্যে আশ্রয় নিয়ে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। বাহিনী গড়ে তুলি। আমাদের কাছে কিছু অস্ত্র ছিল। এ সময় চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ আমাদের ২৫টি রাইফেল ও বেশ কিছু গুলি পাঠায়। আমরা বাঁশখালী থেকে আনোয়ারার একটি অংশ নিয়ে মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলি। এ ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা করেছেন সাবেক এমপি সুলতানুল কবীর চৌধুরী।

এ সময় চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত অরণ্যে আশ্রয় নিয়ে বেশ কয়েকটি গেরিলা গ্রুপ যুদ্ধে অংশ নেয়। তাদের মধ্যে সুলতানুল কবীর গ্রুপ, নুরুল কবীর গ্রুপ, সুবেদার মেজর লতিফ গ্রুপ, সফি গ্রুপ, শাহজাহান ইসলামবাদী গ্রুপ, ডা. ইউসুফ গ্রুপ, কামাল গ্রুপ ও হামিদ গ্রুপ রয়েছে। হামিদ গ্রুপের নেতা আবদুল হামিদ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে নির্মম নির্যাতনে শহীদ হন। এ ছাড়া কক্সবাজারে সুবেদার মেজর ইদ্রিস ও সোবহান গ্রুপ সক্রিয় ছিল।

আগস্ট মাসে লোক মারফত ভারত থেকে আমার কাছে খবর আসে ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কক্সবাজার থেকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ সময় আতাউর রহমান খান কায়সারের নির্দেশে আমরা গ্রুপগুলোকে এক কমান্ডে আনার একটি বৈঠক আহ্বান করি। স্থান নির্ধারণ করা হয় মধুখালী। এ বৈঠকে নদীপথে সাম্পানে আসার সময় চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মরিদুল আলম ও সিটি কলেজের জিএস ফরিদুল আলম রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন এবং তাঁদের হত্যা করা হয়। এরপর সবাইকে এক কমান্ডে আনার বৈঠকটি আর হয়নি।

আমরা কয়েকটি গ্রুপ মিলিতভাবে বরকলে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে বেশ কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করি। এ যুদ্ধে আমাদের সহকর্মী সবুর শহীদ হন।

লেখক : মুজিব বাহিনী কক্সবাজার জেলা প্রধান। ১৯৭১ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা। সাবেক এমপি।

অনুলিখন : লায়েকুজ্জামান

 

সুত্র; কালেরকন্ঠ

পাঠকের মতামত

খেলাভিত্তিক শিক্ষায় ব্র্যাকের তথ্য বিনিময় অনুষ্ঠান

শিশুদের খেলাভিত্তিক শেখা, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ও মনোসামাজিক বিকাশ নিশ্চিতে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো ...

১২ ফেব্রুয়ারি ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনুমতি ছাড়া ওয়াজ মাহফিল নিষিদ্ধ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ধর্মীয় প্রচার কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ...

জামিন বাতিল, মহেশখালীর তোফায়েল হত্যা মামলায় ৭ জন কারাগারে

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়ার মোহাম্মদ শাহ ঘোনা গ্রামের বাসিন্দা জুলাই অভ্যুথানে নিহত শহীদ তানভীর ছিদ্দিকীর ...

ফেসবুক পোস্ট দিয়ে ছাত্রশক্তি নেত্রীর পদত্যাগ‘জুলাইয়ে থানার বাইক চোরের কাছে অনেক সময় হেরে যাই’

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সহযোগী সংগঠন জাতীয় ছাত্রশক্তি কক্সবাজার জেলা শাখার সদ্য ঘোষিত নতুন কমিটি’র ...