ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ২৫/০১/২০২৩ ১২:৫৫ পিএম

ঢাকায় কবর সংরক্ষণ দিন দিন যেন সোনার হরিণে পরিণত হচ্ছে। স্বল্প সময় স্বজনদের স্মৃতি ধরে রাখার সুযোগটুকুও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন নীতিমালায় কবর সংরক্ষণ ফি ১ কোটি থেকে শুরু করে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

কবরের জায়গা কমে যাওয়ায় সংরক্ষণে নিরুৎসাহিত করতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ঢাকায় নয়টি সরকারি কবরস্থান রয়েছে। এর মধ্যে ডিএনসিসি এলাকায় পড়েছে ছয়টি। এর সবগুলোতেই সংরক্ষণ ফি বাড়িয়েছে তারা। গত ১৮ জানুয়ারি ডিএনসিসির সচিব মোহাম্মদ মাহে আলম ফি বাড়ানোর নীতিমালায় সই করেন। রাজধানীর বনানী কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য ৮ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ১৫ লাখ টাকায় কবর সংরক্ষণের সুযোগ ছিল।

নতুন নীতিমালায় ১৫ বছরের সংরক্ষণ ফি ৯২ লাখ টাকা বাড়িয়ে ১ কোটি টাকা এবং ২৫ বছরের সংরক্ষণ ফি ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বাড়িয়ে দেড় কোটি টাকা করা হয়েছে। তা ছাড়া পুনরায় কবর দেওয়ার ফি বনানী কবরস্থানে ২০ হাজার ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার ৫০০ টাকা এবং অন্য পাঁচটি কবরস্থানে ২০ হাজার ৫০০ টাকার ফি ৩০ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে।

উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য সংরক্ষণ ফি ৮ লাখ টাকা এবং ২৫ বছরের জন্য ১৫ লাখ টাকা ছিল। নতুন নীতিমালায় ১৫ বছরের ফি ৬৭ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৭৫ লাখ এবং ২৫ বছরের সংরক্ষণ ফি ৮৫ লাখ টাকা বাড়িয়ে ১ কোটি টাকা করা হয়েছে। উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর কবরস্থান, রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধসংলগ্ন কবরস্থান এবং মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য সংরক্ষণ ফি ৬ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ১১ লাখ টাকা ছিল।

উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য ৪৪ লাখ টাকা এবং ২৫ বছরের ফি ৬৪ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ১৫ বছরের জন্য ৫০ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ৭৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। তা ছাড়া উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য সংরক্ষণ ফি ৬ লাখ থেকে ২৪ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৩০ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ১৫ লাখ থেকে ৩৫ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে।

মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ১৫ বছরের সংরক্ষণ ফি ১৪ লাখ এবং ২৫ বছরের সংরক্ষণ ফি ৩৯ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে এখানে প্রতি কবর সংরক্ষণ ফি ১৫ বছরের জন্য ২০ লাখ টাকা এবং ২৫ বছরের জন্য ৩০ লাখ টাকা। রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধসংলগ্ন কবরস্থানে ১৫ ও ২৫ বছরের সংরক্ষণ ফি ৪ লাখ টাকা করে বাড়িয়ে যথাক্রমে ১০ লাখ ও ১৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনবহুল ঢাকা শহরে মৃত স্বজনদের স্মৃতি ধরে রাখতে সরকারি কবরস্থান ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেই বললে চলে। যাদের কিছু টাকাপয়সা আছে তারা সবাই স্বজনের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে চান। মৃত ব্যক্তির কথা মনে পড়লে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে একটু দোয়া করতে চান। কিন্তু ঢাকার সরকারি কবরস্থানগুলোতে যে পরিমাণ কবর দেওয়া হয়, তাতে সংরক্ষণ ছাড়া স্বজনদের স্মৃতি বেশি দিন ধরে রাখার উপায় নেই।

নাগরিকদের অভিযোগ, অনেক কবরে বছর না ঘুরতেই নতুন করে কবর দেওয়া হয়। মুছে যায় স্বজনের সব স্মৃতি। শুধু আর্থিক সামর্থ্য থাকলেই ঢাকার কোনো কবরস্থানে স্বজনদের কবর সংরক্ষণ করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন ওপরমহলের তদবিরও।

ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকটি কবরস্থানে অগ্রিম কবর সংরক্ষণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও স্থান পাওয়া সাপেক্ষে মৃত ব্যক্তির কবর বিভিন্ন মেয়াদে সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

সংরক্ষণের নির্ধারিত ফি পরিশোধপূর্বক ১৫ ও ২৫ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করা যায়। রায়েরবাজার ও মিরপুরে তুলনামূলক জায়গা বেশি থাকায় সেখানে সংরক্ষণ ফি কম ধরা হয়েছে। নাগরিকরা চাইলে এই দুটি কবরস্থানে সংরক্ষণের মতো জায়গা দেওয়া যাবে। উত্তরা ও বনানী কবরস্থানের জায়গা কমে যাওয়ায় সংরক্ষণে নিরুৎসাহিত করতে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।

ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, গুলশান, বারিধারা ও বনানী এলাকার লোকজন তুলনামূলক ধনী হওয়ায় তারা সবার কবরই সংরক্ষণ করতে চান। এ সংরক্ষণকে নিরুৎসাহিত করতে সংরক্ষণ ফি বাড়ানো হয়েছে।

অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার কবরস্থানগুলোতে জায়গা কমে যাওয়ায় সংরক্ষণ ফি বৃদ্ধি করা হয়েছে। আজিমপুর, জুরাইন ও খিলগাঁও কবরস্থানে ২৫ বছরের জন্য ২৮ বর্গফুট কবর সংরক্ষণ ফি ২০ লাখ টাকা।

এসব কবরস্থানে ১০, ১৫ ও ২০ বছরের জন্য সংরক্ষণ ফি যথাক্রমে ৫, ১০ ও ১৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন ফি ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া পুনরায় কবর দিতে হলে ৫০ হাজার টাকা ফি দিতে হবে।

ডিএসসিসির মুখপাত্র আবু নাছের বলেন, একসময় কেউ মারা গেলে সবাই গ্রামে নিয়ে যেতে চাইতেন। কিন্তু এখন সবাই ঢাকায় কবর দিতে চান। ঢাকা শহরে মৃত স্বজনদের কবর দিতে নিরুৎসাহিত করতেই ফি বাড়ানো হয়েছে।

তিনি বলেন, ঢাকায় যে হারে মানুষ বাড়ছে, সবাই ঢাকায় কবর দিতে চাইলে জায়গা পাওয়া যাবে না। কবরস্থানগুলোর জায়গাও কমে যাচ্ছে।

ডিএসসিসির আজিমপুর কবরস্থান ৩৫ একর জায়গার ওপর। তবে নতুন করে আরও ২ দশমিক ৫০ একর জায়গা বাড়ানো হয়েছে। এখানে ২৫ হাজার কবরের জায়গা আছে। সংরক্ষিত কবর ২ হাজার ৬০০টি। খিলগাঁও কবরস্থান পাঁচ একর জায়গার ওপর অবস্থিত। প্রায় ৪ হাজার কবরের জায়গা রয়েছে এখানে; সংরক্ষিত কবরের স্থান নেই।

১৭ দশমিক ২৬ একর জায়গায় জুরাইন কবরস্থান (ধলপুর ও মুরাদপুর)। এখানে ১২ হাজার কবরের জায়গা রয়েছে। সংরক্ষিত কবর ২ হাজার ৭০০টি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনটি লাইনে প্রায় ২০০ কবর সংরক্ষিত আছে।

কয়েক বছর আগে ৫০০ টাকার দাফন খরচ দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। তবে ডিএনসিসি দাফন ফি আগের মতোই ৫০০ টাকা রেখেছে। কবরস্থানে বাঁশ ও চাটাই সরবরাহের লক্ষ্যে আলাদা ইজারাদার নিয়োগ করা হয়েছে।

প্রতিটি কবরস্থানে বাঁশ ও চাটাই সরবরাহ করার নির্ধারিত মূল্য সব কবরস্থানেই টাঙানো আছে। তবে টাঙানো মূল্য অনুযায়ী কোথাও দাম নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ আছে। তাদের অভিযোগ, বকশিশ ও হাদিয়ার নামে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আদায় করা হয় মৃতের স্বজনদের কাছ থেকে।

পাঠকের মতামত