প্রকাশিত: ২৪/০৮/২০১৮ ৮:৩০ এএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::

বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সঙ্কট একটি স্থায়ী রূপ নিতে পারে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের অনাগ্রহ থাকায় বাংলাদেশের জন্য এ সঙ্কট একটি স্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে উঠতে পারে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দ্য ন্যাশনাল পত্রিকায় প্রকাশিত ‘হোয়াই নিদার মিয়ানমার অর বাংলাদেশ ওয়ান্টস টু ডিল উইথ দ্য রোহিঙ্গা ক্রাইসিস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন ক্যাম্পবেল ম্যাকডারমিড। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি সিঙ্গাপুরে রোহিঙ্গা সঙ্কটের জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করেন মঙ্গলবার। এরপরই তিনি ওই প্রতিবেদন লিখেছেন। এতে তিনি লিখেছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটকে এক সময় বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল শরণার্থী সঙ্কট বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

এক বছর পাড় হয়ে চললেও তাদের দুর্ভোগ যেন অমার্জনীয় হয়ে উঠছে।
গত বছর আগস্ট মাস থেকে শুরু করে তিন মাসের মধ্যে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে ৭ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়। এর ফলে জাতিসংঘের অভিবাসন বিষংক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এ পরিস্থিতিকে অত্যাশিত আকারে এবং দ্রুত গতিতে সংখ্যা বৃদ্ধি হিসেবে আখ্যায়িত করে। তারপর থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে একজন শরণার্থীকেও স্বাগত জানায় নি মিয়ানমার সরকার। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের সহযোগিতা মেনে চলতে উল্লেখযোগ্য চাপ প্রয়োগে অনিচ্ছা দেখাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের তীব্র দাবি থাকা সত্ত্বেও পর্যবেক্ষক ও শরণার্থীরা উভয়ের মধ্যে আতঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, তাদের এই নির্বাসন স্থায়ী হতে পারে।
কক্সবাজার থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে তমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সীমান্তের মধ্যে যেসব রোহিঙ্গা বন্দি হয়ে পড়েছেন তাদের অবস্থা খুবই জটিল। এখানে মিয়ানমার সীমান্ত বেড়া ও কর্দমাক্ত খাড়ির ভিতরে নোম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান করছেন প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী। এই এলাকাটি আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখার আওতায় নয়। এসব শরণার্থী বলছেন, তাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে যে, যদি তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেন তাহলে তারা আর কখনো তাদের দেশে ফিরে যেতে পারবেন না। তারা এখন যে কুড়েঘরে বসবাস করছেন সেখান থেকে মিয়ানমারে তাদের আদি আবাস, ঘরবাড়ি দেখা যায়। জমি দেখা যায়। কিন্তু মিয়ানমার সরকার তাদেরকে ফেরত নিতে চায় না। রোহিঙ্গাদের এই আশ্রয় শিবির থেকে যদি একটি ঢিল ছোড়া হয় তাহলে যতদূর যাবে ঠিক ততদূরে পাহাড়ের চূড়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আউটপোস্ট।
সম্প্রতি মাসখানেক আগে, এই স্থান থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশে সেনাবাহিনী ওই শিবিরের দিকে গুলি করে। মাঝে মাঝেই লাউডস্পিকারে সতর্কতা প্রচার করা হয়। বলা হয়, যারা মিয়ানমার থেকে অন্যায়ভাবে চলে গেছে সীমান্ত অতিক্রম করে তারা ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। আরিফ (৪২) নামে একজন রোহিঙ্গা বলেন, বিশ্ববাসী জানেন যে, আমরা এখানে অবস্থান করছি এক বছর ধরে। আরিফ নিজেকে শুধু একটি শব্দেই পরিচয় দেন। সহানুভূতিশীল বাংলাদেশী সীমান্ত এক রক্ষীর উপস্থিতিতে তিনি জানতে চান, কখন আমাদেরকে আমাদের জন্মভূতিতে ফিরতে দেয়া হবে?
রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরে যেতে উদগ্রীব। তবে তাদেরকে কিছু বিষয়ে নিশ্চয়তা দেয়া না হলে ফিরতে রাজি নন তারা। তারা নাগরিকত্বের অধিকার চান। এটা করা হলে তারা সরকারিভাবে মিয়ানমারের একটি জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। এ ছাড়া তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নিরাপত্তা চান।
এসব দাবি পূরণের জন্য আরো হয়তো অপেক্ষা করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ সরকারের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, আমার মনে হয় এ সঙ্কট সমাধানে উভয় পক্ষকে সমঝোতায় আসতে হবে। ওই কর্মকর্তা মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার এক্তিয়ার রাখেন না বলে নাম প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন।
বাংলাদেশে এ বছরটি নির্বাচনের। এরই মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এ দেশটিকে শাসন করার ক্ষমতা পাওয়ার জন্য নির্বাচনী লড়াই শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মন্ত্রীপরিষদ বলেছে যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বোঝা দীর্ঘদিন টানতে পারে না বাংলাদেশ। ওই কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা চাই তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের দেশে ফিরে যাক।
গত বছরের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। এর আওতায় বলা হয় শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন হতে হবে স্বেচ্ছায়, মর্যাদার সঙ্গে ও নিরাপদ। কিন্তু ওই চুক্তিতে সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয় নি। এখন পর্যন্ত এ চুক্তির আওতায় কোনো শরণার্থীই মিয়ানমারে ফিরে যান নি।
ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশী কর্মকর্তারা মনে করেন সমস্যাটা হলো মিয়ানমারের একগুঁয়েমি। স্বাক্ষরিত চুক্তির অধীনে প্রত্যাবর্তন শুরু হওয়ার আগে প্রথম পদক্ষেপ হলো মিয়ানমারের এসব নাগরিকের পরিচয় সনাক্ত করা। ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের কাছে প্রথম কিস্তিতে ৮০২৩টি নাম পাঠায় বাংলাদেশ। তারপর ছয় মাস হতে চলেছে। তার মধ্য থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজারের সামান্য বেশি মানুষকে যাচাই করতে পেরেছে মিয়ানমার। এ সংখ্যা যেন সমুদ্রে এক ফোঁটা পানি ফেলার মতো।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা বাংলাদেশে ৮ লাখ ৯১ হাজার ২৩৩ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছেন বলে তাদের হিসাবে দেখতে পেয়েছে। বাংলাদেশী ওই কর্মকর্তা বললেন, এখন আপনি কল্পনা করতে পারেন এ প্রক্রিয়ায় কতটা সময় লাগতে পারে। বলতে বলতে তার কণ্ঠে এক অনিশ্চয়তা ফুটে ওঠে। সুসম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুব আগ্রহী। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বলছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়া যাতে মিয়ানমার মেনে নেয় সে জন্য তাদেরকে আগ্রহী করে তোলার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। বাংলাদেশ সরকারের আরেকজন কর্মকর্তা বলেছেন, শুধু বৈশ্বিক চাপের কাছেই সাড়া দেয় মিয়ানমার।
কিন্তু এটা এমন একটি বিষয় নয়, যে বিষয়ে একীভূত একটি চুক্তি আছে। মিয়ানমার ইস্যুতে জাতিসংঘের রেজুলেশন বা প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে চীন ও রাশিয়া।
পক্ষান্তরে, গত সপ্তাহে মিয়ানমারের সামরিক জেনারেলদের বিরুদ্ধে টার্গেটেড অবরোধ ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এসব সামরিক নেতা পুরো মিয়ানমারজুড়ে জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালানোর জন্য দায়ী। এর মধ্যে রয়েছে জাতি নিধন। গণহত্যা। যৌন নির্যাতন। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ও অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের টেরোরিজম অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আন্ডার সেক্রেটারি সিগাল মান্দেলকার বলেছেন, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের অবশ্যই ন্যায়বিচচার পেতে হবে এবং বিচার হতে হবে তাদের যারা নৃশংসতাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য কাজ করেছে। বিচার হতে হবে এই ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও। মিয়ানমারের সেনা ইউনিটগুলো ও নেতাদেরকে অবশ্যই নৃশংসতা থামানোর ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত জোরপূর্বক প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে পর্যাপ্ত শুনানির উপযোগিতা আছে কিনা সে বিষয়ে জুরিসডিকশন দেবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। রাখাইনে সহিংসতার বিষয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উভয়েই রিপোর্ট প্রকাশ করবে বলে প্রত্যাশা রয়েছে।
কিন্তু অবরোধের হুমকি অথবা উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমারের মন গলাতে পারবে না বলেই মনে হয়। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক রাখাইনের উন্নয়নে মিয়ানমারকে ১০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব করেছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে আপাতদৃষ্টে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনকে জাতিসংঘ যখন জাতিনিধন হিসেবে বর্ণনা করেছে তখন মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
রাখাইন সহিংসতা নিয়ে সম্প্রতি সেনাবাহিনী ১১৭ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এটি রচনা করেছে সেনাবাহিনীর জনসংযোগ বিষয়ক পরিচালনা পরিষদ ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ক কল্যাণ শাখা। এ রিপোর্টে গণহত্যার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। উল্টো তারা যুক্তি দেখিয়েছে বাঙালি অনুপ্রবেশকারীরা একটি স্বাধীন আরকিস্তান গঠন করার চেষ্টা করছিল। এতে বলা হয়, কাক ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করলেই সে কখনো ময়ূর হতে পারে না।
এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি একটি নৈরাশ্য যোগ করে।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতিসংঘের অনেক রিপোর্ট লিখেছেন নাগরিক সুরক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিয়াম মাহোনি। তিনি এ পরিস্থিতিতে বলেন, মানুষ এখন রোহিঙ্গাদের এ অবস্থাকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তুলনা করছে। তিনি আরো বলেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা এখানে শরণার্থী হিসেবে থেকে যেতে পারে।
এরই মধ্যে এ বিষয়টি পূর্বাহ্নেই বুঝতে পেরেছে এনজিওগুরো ও জাতিসংঘ। তারা এ সঙ্কটের দীর্ঘমেয়াদী সাড়া পাওয়ার পরিকল্পনা করছে, যদিও বাংলাদেশ সরকার আশা করছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন খুব শিগগিরই শুরু হবে। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কথা বলার ক্ষেত্রে বেশি ভাগই সতর্কতা অবলম্বন করছেন।
বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেডড ক্রিসেন্ট সোসাইটির অপারেশন ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক কেনেডি। তিনি আশ্রয় শিবিরে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মানে সরকারের খুব আগ্রহকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা মধ্যম-দশা অবলম্বন করে কথা বলছেন।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কতদিন বাংলাদেশে থাকবে তার আরেকটি চিত্র ফুটে উঠেছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচার-এর প্রাণিবিজ্ঞানিদের কথায়। বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় এশিয়ান যেসব হাতি রয়েছে তাদের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা নিয়ে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা ওই আশ্রয় শিবিরের ভিতর দিয়ে পশুদের মাইগ্রেশন করিডোর নির্মাণের জন্য তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।
ক্রমশ রোহিঙ্গাদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দিচ্ছে যে, এই আশ্রয়শিবিরই হতে পারে অন্তহীন দিনের জন্য তাদের বাড়িঘর। ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া একটি ব্লকের নেতা ৩৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, মিয়ানমারে শান্তি চেয়েছেন আমার প্রপিতামহ। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার আগে তা দেখে যেতে পারেন নি। আমার পিতাও পাবেন নি। আর এখন আমরা এখানে অবস্থান করছি একটি শান্তিপূর্ণ স্থানের আশায়। মনে হয় শান্তি চাইতে চাইতে আমরা সবাই মারা যাবো।  সুত্র: মানবজমিন

পাঠকের মতামত