
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে আস্থার সম্পর্ক গড়ার বদলে বাংলাদেশ আরাকান আর্মির ওপর ‘চাপ সৃষ্টি’ করেছে বলে দাবি করেছেন সশস্ত্র সংগঠনটির কমান্ডার ইন চিফ মেজর জেনারেল তোয়ান মারত নাইং।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে আস্থার সম্পর্ক গড়ার বদলে বাংলাদেশ আরাকান আর্মির ওপর ‘চাপ সৃষ্টি’ করেছে বলে দাবি করেছেন সশস্ত্র সংগঠনটির কমান্ডার ইন চিফ মেজর জেনারেল তোয়ান মারত নাইং। তিনি বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল। আমরাও ভেবেছিলাম, শরণার্থী ইস্যুতে আমাদের লক্ষ্য অভিন্ন। ধরে নিয়েছিলাম এ অভিন্ন লক্ষ্য আমাদের সম্পর্ককে আরো গঠনমূলকভাবে পরিবর্তন করবে। কিন্তু যখন নীতি বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনা করতে এগোলাম, তখন তারা আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে। তাদের উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে আস্থা তৈরি করা এবং সক্ষমতা গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেয়া।’ থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত মিয়ানমারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরাওয়াদ্দিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তোয়ান মারত নাইং।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘যদি সত্যিই আমরা প্রত্যাবাসনে কাজ করতে চাই, তাহলে প্রথমেই তাদের (রোহিঙ্গা) নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা থাকতে হবে, যাতে তারা সেখানে ফিরে গিয়ে বাঁচতে পারে। কিন্তু এর পরিবর্তে তারা শুধু আমাদের ওপর চাপ বাড়িয়েছে, আর তাতেই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি। তবুও আমরা ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছি। কীভাবে গঠনমূলক উপায়ে বিষয়টি মোকাবেলা করা যায়, কীভাবে তারা আমাদের স্বীকৃতি দিতে পারে এবং আমাদের সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করতে পারে, সে বিষয়ে কথা বলছি।’
মিয়ানমারে মুসলিমদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বিষয়ে মেজর জেনারেল তোয়ান মারত নাইং বলেন, ‘আমাদের কিছু সৈন্য কখনো কখনো আচরণবিধি ভঙ্গ করেছে। আমরা তাদের শাস্তিও দিয়েছি। গণমাধ্যমগুলো খবর প্রকাশ করেছে। আমাদের কিছু সৈন্য অপরাধ করে সেনাবাহিনী ছেড়েও পালিয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটনা নীতিগতভাবে আমরা কখনো অনুমোদন করি না। আমাদের সঙ্গে আইন মেনেই কাজ করতে হবে। যারা আইন ভেঙেছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা এরই মধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছি।’
রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ জাতিগোষ্ঠীর নামকে ঘিরে বিতর্ক নতুন বিষয় নয়। তারা দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ নাম ব্যবহার করে আসছে। শুধু রাখাইনেই নয়, পুরো মিয়ানমারজুড়ে। রাখাইন, বার্মার ইতিহাস নিয়ে লেখা বইগুলো পড়লে দেখা যাবে, সেখানে নানা দৃষ্টিভঙ্গির লেখকদের কারণে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। মানুষ নিজেদের পছন্দমতো তথ্য বেছে নিয়ে নতুন গল্প তৈরি করে, অন্যদের প্রভাবিত করার জন্য।’
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান একদিনে সম্ভব নয় জানিয়ে তোয়ান মারত নাইং বলেন, ‘আমরা নিয়ন্ত্রণ নিলেও তা মিলিয়ে যাবে না। এর কোনো জাদুকরী সমাধান নেই। সময় নিয়ে এর মোকাবেলা করতে হবে। তারা (রোহিঙ্গা) বলে সবকিছু আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে হওয়া উচিত। অথচ প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব নিজের দেশের পতাকা, আইন ও সংবিধানকে সম্মান করা। কিন্তু তারা সেগুলো অগ্রাহ্য করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে আলোচনা করার বদলে আমাদের ধীরে ধীরে বৈষম্য দূর করতে হবে। কিন্তু বাইরের হামলা, উসকানি ও অভিযোগ যতদিন চলবে, এ সমস্যার সমাধান ততই কঠিন হবে।’
রাখাইন রাজ্যে শান্তিপূর্ণ ও কার্যকর প্রশাসন গঠন এবং উন্নয়নশীল সমাজ গড়ে তুলতে আরাকান আর্মি কোনো জাতিগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে যাচ্ছে না বলেও দাবি করেন আরাকান আর্মির কমান্ডার ইন চিফ। সশস্ত্র সংগঠনটির সর্বোচ্চ এ নেতা বলেন, ‘মানবাধিকার নিয়ে কথা বললে আমাদের প্রতিটি মানুষকে শুধু একজন ব্যক্তি হিসেবেই নয়, নাগরিক হিসেবেও দেখতে হবে। আমাদের ধীরে ধীরে এগোতে হবে, যাতে তাদের প্রকৃত সমমর্যাদা নিশ্চিত করা যায়। এখন আমি একজন রাজনৈতিক নেতা, তাই সবার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া এবং তা কার্যকর করার দায়িত্ব আমার। একই সঙ্গে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে হবে। আমরা সবসময় তাদের বলি, তারা যেন জননিরাপত্তা, বিচার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি সরকারি সেবায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।’
আরাকান আর্মির ওপর হামলা চালাতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা গত দুই-তিন বছর ধরে বিভিন্ন স্থানীয় গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা খুবই বিপজ্জনক বাজি। জান্তা স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য এটা করেছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে গোটা অঞ্চলের জন্য বিশৃঙ্খলার দরজা খুলে দিয়েছে।’
কিছু গোষ্ঠী রোহিঙ্গা তরুণদের উগ্র মতাদর্শ শেখাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। মেজর জেনারেল তোয়ান মারত নাইং বলেন, ‘কখনো কখনো সুযোগ পেলে তারা রাখাইনের ভেতরে ঢুকে মাইন বিস্ফোরণ ঘটায় বা গুলি চালায়, তারপর আবার বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে যায়। আমরা চাই বা না চাই, প্রতিবেশী বেছে নেয়ার সুযোগ নেই—দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আমাদের ধৈর্য ধরতেই হবে। সে কারণেই আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছি। কঠোর প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ধৈর্য ও কৌশলের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার পথ বেছে নিয়েছি।’
রাখাইনের বুথিডং ও মংডু অঞ্চলে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে শরণার্থী শিবির থেকে আন্দোলন পরিচালনাকারী রোহিঙ্গা নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা কৌশল আলাদা বলেও মন্তব্য করেন তোয়ান মারত নাইং। তিনি বলেন, ‘রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে অনেক বেশি। শরণার্থী শিবিরের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। অনেকেই শান্তিপূর্ণভাবে রাখাইনে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত তরুণদের মনে ঘৃণা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে আরাকান আর্মি তাদের চোখে সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে উঠছে। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘শরণার্থী শিবিরের অনেক মানুষই রাখাইনে ফিরে যেতে চায়, অনেকেই এরই মধ্যে ফিরে গেছে। রাজনৈতিক কারণে জাতিসংঘ এবং কিছু বাংলাদেশী কর্মকর্তা কেবল সে মানুষগুলোকেই তুলে ধরে যারা মিয়ানমার থেকে পালিয়েছে। কিন্তু শত শত পরিবার যে বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসেছে, সেটার কথা তারা কখনো বলে না।’
পশ্চিমে থাকা প্রবাসী গোষ্ঠী রাখাইনে ঐক্য, উন্নয়ন ও সম্প্রীতি দেখতে চায় না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের উদ্দেশ্য ও কৌশল হলো সংঘাত সৃষ্টি করা। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার কথা তুলে ধরে এটা দেখানো যে রোহিঙ্গারা রাখাইনদের সঙ্গে থাকতে পারে না এবং তাদের আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন, যাতে পশ্চিমা শক্তিগুলো রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট নীতির আওতায় এসে তাদের মুক্ত করতে পারে। তারা গঠনমূলক অগ্রগতি চায় না।’
রাখাইন যখন সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণে ছিল তখন রোহিঙ্গারা পালিয়ে গেছে, এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ থাকার পরও তারা কেন পালাচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তোয়ান মারত নাইং বলেন, ‘এটা বোঝা কি কঠিন? মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ চলছে। সাধারণ মানুষ বেকার, কোথাও যেতে পারে না, তাদের দৈনন্দিন জীবন নিরাপদ নয়। যে এলাকায় শরণার্থীদের ফেরানোর কথা বলা হচ্ছে, সেখানে প্রতিদিন সামরিক জান্তা বোমা ফেলছে। মানুষ বাঁচার জন্য পালাবে, বাংলাদেশ সব সীমান্ত বন্ধ করলেও পালাবে। কিন্তু শরণার্থী সম্মেলনে বলা হলো, সেখানে সহিংসতা ও অপহরণের ঘটনা ঘটছে। এজন্য যে সামরিক জান্তা দায়ী তা কিন্তু বলেনি। উল্টো আমাদেরই দোষারোপ করা হলো। আমরা যদি একটিমাত্র ভুলও করি, তারা সেটিকে হাজার গুণ বাড়িয়ে তোলে।’
আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে মাদক পাচারের অভিযোগ আনা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা আমাদের অভিযুক্ত করছে তারা নিজেরাই সবচেয়ে ভালো জানে এ মাদক কোথা থেকে আসে, কোথায় তৈরি হয় এবং কোথায় যায়। এ মাদকগুলোর দাম অত্যন্ত বেশি। যদি আমরা সত্যিই এ পরিমাণ টাকায় মাদক বিক্রি করতাম, তাহলে জান্তার যুদ্ধবিমানগুলোকে মাছির মতো নামিয়ে আনতে পারতাম। জান্তার নৌবাহিনী কি জানে না যে আয়েরওয়াদ্দি অঞ্চল ও ইয়াঙ্গুন বন্দর দিয়ে মাদক পাচার হয়? উত্তর শান রাজ্য থেকে ইয়াঙ্গুন পর্যন্ত এসব মাদক কীভাবে পৌঁছায়? তারা কারেন রাজ্যের একটি পিস্তল পর্যন্ত ট্র্যাক করতে পারে, তাহলে বিপুল পরিমাণ মাদক ইয়াঙ্গুনে কে আনল তা জানে না? তারা আমাদের বৈধতা দুর্বল করতে মিয়ানমারের সর্বত্র পাওয়া মাদকের জন্য আমাদেরই দোষারোপ করে।’
মাদক পাচারের বিষয়ে বাংলাদেশের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশী সংবাদপত্রগুলো বলছে, মাদক সাগরে জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা তো সাগর নিয়ন্ত্রণ করি না। আমরা কেবল উপকূল থেকে পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরত্বে অবৈধ মাছ ধরার নৌকা আটকাই। ইয়াঙ্গুন বা অন্যান্য রুট থেকে আসা মাদক বাণিজ্যের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা যেভাবেই আমাদের ঘিরে ধরুক আমরা আমাদের পথেই এগিয়ে যাব।’ কোনো ইস্যুতে আরাকান আর্মি কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাবে না, বরং পরিস্থিতি যাতে আরো উত্তপ্ত না হয় সে চেষ্টা করবে বলেও জানান মেজর জেনারেল তোয়ান মারত নাইং।
তথ্যসূত্র, দৈনিক বণিক বার্তা

পাঠকের মতামত