প্রকাশিত: ২২/০৯/২০১৭ ৯:২৭ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১:১০ পিএম

ডেস্ক রিপোর্ট::
বৈশ্বিক চাপে পড়ে আবারও নমনীয়তার ভান ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর দরদ দেখানোর কৌশল নিয়েছে মিয়ানমারের সরকার ও রাখাইনে হত্যাকাণ্ড চালানো দেশটির সেনাবাহিনী। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে গঠিত মিয়ানমার সরকারের কমিটি কয়েক দিন ধরে রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন করেছে।

আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আনান কমিশনের কিছু সুপারিশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হবে বলে দ্য মিয়ানমার টাইমসকে জানিয়েছেন কমিটির চেয়ারম্যান উইন মায়াত আই। রাখাইনে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানোয় বিশ্বনেতাদের সমালোচনা ও অবরোধ আরোপের দাবির মুখে রোহিঙ্গা নিধনের হোতা দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং মঙ্গলবার রাখাইনে গেছেন। গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে হত্যা, ধর্ষণ, পুড়িয়ে মারা ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য দেশটির সেনাপ্রধানই মূল ভূমিকা পালন করেছেন।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ভেতরে ও সাইড লাইনে চলা বিভিন্ন বৈঠকে মিয়ানমারবিরোধী তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কঠোরতা দেখাচ্ছেন বিশ্বনেতারা। এ প্রেক্ষাপটে গত বুধবার অধিবেশনে বক্তব্য দেন মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হেনরি ভ্যান থি। তিনি অং সান সু চির বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র। তিনি সীমান্তের ওপারের অবস্থা দেখতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মিয়ানমারে আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলেছেন। এর মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়নে তাঁর সরকারের চেষ্টার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। বাস্তবে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন, নির্যাতন কমাতে দেশটির সরকার, সেনাবাহিনী কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

চাপে পড়ে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী নমনীয়তার কৌশল নিলেও দেশটির উগ্র জাতীয়তাবাদী রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের জন্য ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রসের ত্রাণ নিয়ে যাত্রা শুরু করা একটি নৌকার গতিরোধ করে পেট্রলবোমা মেরেছে।

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও উগ্রবাদীদের চালানো বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করে দেশটির সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও সহায়তা বাতিল করেছে যুক্তরাজ্য। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ ও দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার প্রধান জেইদ রাদ আল-হুসেইন বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের উচিত মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।

আনান কমিশন গত ২৪ আগস্ট সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরদিনই মিয়ানমারের পুলিশ চৌকিতে হামলার ঘটনা ঘটিয়ে দেশটির সেনাবাহিনী, পুলিশ ও উগ্রবাদীরা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া শুরু করে। তখন থেকে এ পর্যন্ত চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। গুলি করে হত্যা ও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে। এতে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিদেশি কূটনীতিকদের ডেকে আনান কমিশন বাস্তবায়নে কমিটি গঠনের কথা বলেন দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের আগে এই কমিটি গঠন করা ছিল শুধুই লোক দেখানো।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই কমিটি কার্যত কোনো কাজই করেনি। উল্টো রাখাইনের রোহিঙ্গাদের প্রতি নির্যাতন চলতেই থাকে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ব সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর চাপও বাড়াতে থাকে। জাতিসংঘসহ বৈশ্বিক নেতা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে থাকা মিয়ানমারকে একতরফাভাবে সমর্থন করার অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসে চীনও। দেশটি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়নে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ সংকট সমাধানে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতও মিয়ানমারের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের কথা বলছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি, আসিয়ানসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধনের বিরুদ্ধে একাট্টা হওয়ায় বেশ চাপে পড়ে এখন সুর নরম করার ভান করছে মিয়ানমার।

আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ১৩ সেপ্টেম্বর যে কমিটি গঠন করেছে মিয়ানমার সরকার, সেই কমিটির সদস্যরা গত ১৮ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাখাইন এলাকা পরিদর্শন করেছে। ওই কমিটির চেয়ারম্যান ও মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উইন মাথায় আই গতকাল দ্য মিয়ানমার টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে বলেছেন, রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার প্রকল্প নিয়ে দ্রুত কিভাবে কাজ করা যায়, তা দেখা হয়েছে। রাখাইনের উদ্বাস্তুদের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন এবং তাদের পুনর্বাসনে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়েছেন। জরুরিভাবে রাখাইনে যেসব প্রকল্প দরকার সেগুলো দুই সপ্তাহের মধ্যে নেওয়া হবে।

ওই কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও রাখাইন রাজ্যের মন্ত্রী ইউ নি পু বলেছেন, কমিটি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় নেবে। তবে আনান কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে যেগুলো বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও রাখাইনের জনগণের জন্য কল্যাণকর সেগুলো বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এ ছাড়া আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও নেওয়া হবে।

বিশ্বনেতাদের চাপের মুখে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ভাষণে মিয়ানমারে স্টেট কাউন্সেলর শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি বলেছেন, কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হবে। যেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে, সেগুলো আগে বাস্তবায়ন করা হবে।

এদিকে, রোহিঙ্গা নিধনের হোতা মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল অং হ্লাইং এই ২৫ দিনের মধ্যে গত বুধবার প্রথম রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে গেছেন। মিয়ানমারের সংবাদপত্র ইরাবতির তথ্যানুযায়ী, সেনাপ্রধানের কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, রাখাইন সেনা কমান্ডের কমান্ডার ও সেনাবাহিনীর প্রকৌশল ও চিকিত্সাসেবা বোর্ডের পক্ষ থেকে চলমান নিরাপত্তা অভিযান সম্পর্কে অভিহিত করা হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিরাপত্তা অভিযান বললেও জাতিসংঘ এই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ বলে চিহ্নিত করেছে।

পাঠকের মতামত

রোহিঙ্গাদের ৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসন বিভাগ এবং ইউএসএআইডিয়ের মাধ্যমে কক্সবাজার, ভাসানচর এ অঞ্চলের ...