উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯/০৩/২০২৩ ৯:৩৮ এএম

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে খুনোখুনি কোন মতেই বন্ধ হচ্ছেনা। বুধবার (০৮ মার্চ) সকালে মুখোশধারী দুর্বৃত্তদের গুলিতে লম্বাশিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ছৈয়দ হোসেন নিহত হন। চলতি বছরের গেলো ২ মাসে দুষ্কৃতিকারিদের গুলিতে খুন হয়েছে ৮ জন রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, ক্যাম্পে অপরাধ কর্মকান্ডে সহযোগিতা না করায় টার্গেট করে কমিউনিটি নেতাদের খুন করা হচ্ছে। প্রশাসন বলছে, ক্যাম্পে সংগঠিত ঘটনাগুলো নিয়ে তারা চিন্তিত। তবে যৌথ অভিযানের পাশাপাশি সমন্বিত প্রচেষ্টায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে জানিয়েছে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন।
বুধবার সকাল ৮টায় উখিয়ার আশ্রয় শিবিরে ‘আধিপত্য বিস্তারের জেরে’ দুষ্কৃতিকারিদের গুলিতে রোহিঙ্গাদের এক নেতা নিহত হয়েছেন। লম্বাশিয়া ২-ওয়েস্ট নম্বর রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের ডি-ব্লকে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত ছৈয়দ হোসেন ওরফে কালাবদা (৫২) উখিয়ার লম্বাশিয়া ২-ওয়েস্ট রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের ডি-ব্লকের আজিজুর রহমানের ছেলে। তিনি আশ্রয় শিবিরটির ডি-ব্লকের মাঝি (কমিউনিটি নেতা) হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

স্থানীয়দের বরাতে উখিয়াস্থ ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিআইজি) ছৈয়দ হারুনুর রশিদ বলেন, সকালে উখিয়ার লম্বাশিয়া ২-ওয়েস্ট রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের ডি-ব্লকে নিজের ঘরের পাশে একটি দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এসময় ৭/৮ জন মুখোশধারী একদল দূর্বৃত্ত তাকে লক্ষ্য করে উপর্যুপুরি গুলি ছুড়ে। এতে ছৈয়দ হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। খবর পেয়ে এপিবিএন পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই দূর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।
“পরে ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ছৈয়দ হোসেন উদ্ধার করে কুতুপালং আশ্রয় শিবির সংলগ্ন এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে আসে। এসময় হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।”
এডিআইজি বলেন, “রোহিঙ্গা শিবিরে কয়েকটি দুষ্কৃতিকারি দল সক্রিয় রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকান্ড ঘটেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছে, মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্টি আরসা’র সন্ত্রাসীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। আর নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে।”
এদিকে গত সোমবার (০৬ মার্চ) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নূর হাবি ওরফে ডা. ওয়াক্কাস (৪০) নামে এক রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। উখিয়ার বালুখালীস্থ ৯ নম্বর ক্যাম্পের সি ব্লকে ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এপিবিএন জানায়, নিহত ওয়াক্কাস আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সক্রিয় কমান্ডার ছিলেন। তিনি ক্যাম্পের সন্ত্রাসীদের তালিকায় শীর্ষ ছিলেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকা ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. আমির জাফর জানান, দুষ্কৃতিকারীরা শীর্ষ সন্ত্রাসী ড. ওয়াক্কাসকে গুলি করে হত্যা করেছে। সে সক্রিয় আরসার কমান্ডার নেতা ছিল। হত্যাকারীদের ধরতে অভিযান চলছে।
নিহতের পরিবারের ভাষ্যমতে উখিয়া থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, অন্তত ৩০ জনের মুখোশধারী দুর্বৃত্তের দল বালুখালী ৯ নম্বার ক্যাম্পে গিয়ে ড. ওয়াক্কাসকে ঘিরে ফেলে। পালানোর চেষ্টাকালে তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে এনজিও এমএসএফ পরিচালিত হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে রবিবার (০৫ মার্চ) বিকেল ৩টার দিকে বালুখালীর ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। টানা তিন ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হলেও পুড়ে যায় ২ হাজার ঘর। ক্ষতিগ্রস্ত হন ১২ হাজার রোহিঙ্গা। এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের তথ্য পাওয়া যায়নি।
জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুই হাজারের বেশি ঘর (শেল্টার) পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি। ক্যাম্প-১১ আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা থাকেন ৩২ হাজার ২০০ জন। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৯০টির বেশি বেসরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, লার্নিং সেন্টার, ত্রাণকেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে।
তবে ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাটির জন্য কথিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দায়ী করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। তারা জানান, কথিত সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। শুধু এক স্থানে না, একযোগে অন্তত পাঁচটি জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আর অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ানকে প্রধান করে এই কমিটি করা হয়। সোমবার সকাল থেকে তদন্ত কমিটি অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে। যা বৃহস্পতিবার (০৮ মার্চ) তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, এসব ঘটনার পেছনে কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো জড়িত। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, দুটি কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কমিউনিটি নেতাদের খুন করছে কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। এক হচ্ছে, কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ব্যাপারে কেউ তথ্য দিলে তা তারা জেনে যায়। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে তথ্য দাতাকে ধরে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করছে। কারণ ক্যাম্পে তাদের অসংখ্য নের্টওয়াক রয়েছে। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, আগে অনেক কমিউনিটি নেতা কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করত। কিন্তু এখন না করাতে মুনাফিক হয়ে গেছে বলে টার্গেট করে হত্যা করছে।
ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে খুনোখুনি বাড়ায় আতংকে স্থানীয়রা। এসব ঘটনার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে দাবি জনপ্রতিনিধিদের।
হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পকে ঘিরে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বাংলাদেশকে যারা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, তারা কিন্তু রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে এসব ঘটনাগুলো করাচ্ছে।
আর প্রশাসন বলছে, ক্যাম্পে সংগঠিত ঘটনাগুলো নিয়ে তারা চিন্তিত। আর দায়িত্বরত আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে তো আমরা অবশ্যই চিন্তিত। তবে, ক্যাম্পে ৩টি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) রয়েছে। সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছে ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি। তারা প্রতিনিয়ত কাজ করছে। আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করছি। এছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে। তারপরও কিছু ঘটনা ঘটছে। তবে, এসব ঘটনা নিয়ে আমরা কিছুটা চিন্তিত। আমরা সবাই চেষ্টা করছি, কিভাবে ক্যাম্পে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকা ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. আমির জাফর বলেন, ক্যাম্পে বেশ কিছু গ্রুপ কাজ করে। যাদের কাজ হচ্ছে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আধিপত্য বিস্তার একটা বিষয় থাকে। এরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে এসব অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে।
মো. আমির জাফর আরো বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। কখনো এপিবিএন পুলিশ একা করছে, কখনো জেলা পুলিশ বা র্যাবকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে। তবে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় আশা করি, ক্যাম্পের এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

উখিয়া থানা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, গেলো ৬ মাসে ক্যাম্পে দুষ্কৃতিকারিদের গুলিতে নিহত হন ১৩ জন রোহিঙ্গা। এসব ঘটনায় ১৩টি মামলা দায়েরের পাশাপাশি গ্রেফতার করা হয়েছে ৩৮ জনকে। সুত্র: দৈনিক কক্সবাজার

পাঠকের মতামত

মিয়ানমারে সংঘাত/টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ঢুকল আরও ৯ বিজিপি সদস্য

মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ...