
তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে উদ্বেগজনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন ক্যাসিনো জুয়া। ক্যাম্পের বেকার যুবসমাজ ‘ডুবে’ আছে জুয়ার নেশায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই জানেন জুয়া মানেই ‘ওয়ানএক্সবেট’। ক্যাম্পের ১২-১৩ বছরের বালক থেকে শুরু করে ৫০-৫৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গাদের হাতেও অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোন রয়েছে।
আছে কয়েক শ ওয়াইফাই মোবাইল নেটের দোকান। রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক নানা অপরাধজনক ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণও ক্যাসিনো জুয়া। জুয়া নিয়ে মাস্টার (প্রধান) এজেন্টরা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অন্যদিকে জুয়ার নেশায় পড়ে ফতুর হচ্ছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাত দেড়টার দিকে উখিয়া উপজেলার ১৯ নম্বর তাজনিমারখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সি-ব্লকে মোবাইল ফোনে অনলাইন ক্যাসিনো জুয়া খেলার সময় দুজন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ হারেছ (৪১) ও মোহাম্মদ সেলিম (৩৮)। উখিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাকির হোসেন মাসুদ অভিযান চালিয়ে দুই রোহিঙ্গাসহ তাঁদের মোবাইল ফোন ও বিকাশের কাগজপত্র উদ্ধার করে থানায় ১৮৬৭ সালের প্রকাশ্য জুয়া আইনে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ সালের ৩০(২) ধারায় একটি মামলা করেন। পরে আদালতের মাধ্যমে আটক দুজনকে কারাগারে পাঠানো হয়।
উপপরিদর্শক জাকির হোসেন মাসুদ গতকাল শুক্রবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাহিঙ্গাদের অনেকে নেশায় পড়ে জুয়াখেলা থেকেই মূলধন খোঁজে। না পেয়ে শুরু করে ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণসহ নানা অপরাধজনক ঘটনা।’ তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক স্বল্পদিনের চাকরির অভিজ্ঞতায় বলা যায়, অনলাইন জুয়া বন্ধ করা গেলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধের মাত্রা অনেক কমে যাবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনলাইন জুয়া খেলাও ক্যাম্পগুলোর রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতেই নিয়ন্ত্রিত। ক্যাসিনোর মাস্টার এজেন্ট থেকে সাব এজেন্ট হিসেবে যারা কাজ করে, তারা কোনো না কোনো রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত।
ক্যাসিনোর এজেন্টরাই লাখ লাখ টাকার জোগান দিয়ে রোহিঙ্গা কিশোর-তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে জুয়া খেলার জন্য। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লকে এই ক্যাসিনো এজেন্টরা ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে বসে। তারা টাকাকে ডলারে রূপান্তর করে দেয়।
অস্ত্রধারী আরসা ও আরএসওসহ বিভিন্ন রোহিঙ্গাগোষ্ঠীর ভয়ে ক্যাসিনো এজেন্টদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথাও বলতে পারে না। ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গারা শুধু ক্যাসিনো নামে নয়, আরো বেশ কয়েকটি নামের জুয়াখেলায় মত্ত থাকেন। এর মধ্যে রয়েছে ছক্কা খেলা, বলখেলা, চাকা মারা, ডলাডলি খেলা ও রংখেলা।
ক্যাম্পগুলোতে অনলাইন জুয়ায় পড়ে ফতুর হয়ে যাওয়ার সংখ্যা ক্রমে বাড়লেও জুয়াখেলা কমছে না। উখিয়ার কুতুপালং এক নম্বর ক্যাম্পের ইস্ট ব্লকের রোহিঙ্গা বাসিন্দা রফিক জুয়ায় তিন লাখ টাকা হারিয়ে নিজের ঘরটি দিয়েও রেহাই পাননি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে হয়েছে। তিনি ক্যাসিনো খেলেছিলেন টাকা ধার নিয়ে। টাকা হারানোর পর পাওনাদাররা মিলে রফিকের স্ত্রীকে পাঠিয়ে দেন বাপের বাড়িতে। তারপর তাঁরা ঘরটি দখল করে নেন।
শফিউল মোস্তফা নামের এক রোহিঙ্গা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি নেশায় পড়ে ৭১ হাজার টাকা হারিয়েছি। এ টাকা মায়ানমার থেকে এনেছিলাম। আমার বাবা পবিত্র কোরআন শরিফ ছুঁয়ে শপথ করার পর আমি খেলা বন্ধ করেছি।’ তিনি জানান, ক্যাম্পের ১২/১৩ বছরের বালকরাও অনলাইনের জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। ক্যাম্পে যত রোহিঙ্গার হাতে অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোন রয়েছে তাদের আশি শতাংশই অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। ক্যাম্পের অলিগলিতে ওয়াইফাই মোবাইল নেটের দোকান। স্থানীয় গ্রামীণ বাসিন্দাদের নাম দিয়ে রোহিঙ্গারাই ওয়াইফাই ব্যবসায় জড়িত। প্রতিমাসে একটি মোবাইল ফোন ২০০-৩০০ টাকার বিনিময়ে ওয়াইফাই সুবিধা ভোগ করে থাকে।
বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ক্যাসিনো অনলাইন জুয়ার এমনই প্রসার ঘটেছে যে ক্যাম্পের প্রায় প্রতিটি ঘরেই রয়েছে আসক্তরা। কুতুপালং এলাকার স্থানীয় গ্রামের লোকজনের অভিযোগ, নিবন্ধিত কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী দুই যুবকের কারণে স্থানীয় ছাত্র, যুবক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনও ক্যাসিনোতে পা বাড়াচ্ছে। আমিন এবং আবদুল্লাহ নামের দুই রোহিঙ্গা যুবক ক্যাসিনোর মাস্টার এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্প ফেলে স্থানীয়দেরও নানাভাবে প্রলুব্ধ করছে ক্যাসিনো জুয়াখেলার অংশীদার হতে। স্থানীয় লোকজন এ জন্য অইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা হেড মাঝি জানায়, অনলাইন জুয়ার নেশায় পড়ে ইয়াবা কারবারে জড়িতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ইদানীং ইয়াবা কারবারের চেয়ে লাভ বেশি হচ্ছে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ে। তাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক অপহরণের ঘটনাও বেশি ঘটে থাকে। আবার মুক্তিপণ আদায়ে ব্যর্থ হলে অপহরণকারীদের হাতে অপহৃতদের হত্যার শিকার পর্যন্ত হতে হয়। এভাবেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অনলাইন জুয়ার কারণে দিন দিন অপরাধজনক ঘটনা বাড়ছে।
সুত্র,কালেরজন্ঠ
পাঠকের মতামত