প্রকাশিত: ০৬/১০/২০১৭ ৮:২৮ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১২:৩৭ পিএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা প্রতিদিন মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে। তারা বলছে- যদি এক সপ্তাহ পর আরাকানে কাউকে পাওয়া যায়, তাহলে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হবে। নতুন আসা রোহিঙ্গারা এ কথা জানিয়েছেন।

এছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা ভালো কাঠের বাড়িগুলো সেনা সদস্যরা দখল করছে বলে জানান আরাকানের কিয়াংমং ও নাফপুরা গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা যুবক জাফর আলম ও মোস্তাক আহমদ।

সেনা ও মগদের হুমকির কারণে এখন শত শত রোহিঙ্গা প্রতি রাতে ছোট ছোট নৌকায় করে জীবনের ঝুকি নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন।

বুধবার রাত ১০টায় শাহপরীর দ্বীপের জেটির পূর্বপাশে একটি ছোট নৌকা এসে পৌঁছে। সেটিতে ২১ জন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু। এসময় দূর থেকে ভেসে আসে কয়েকজন নারী ও শিশুর কান্না। তখন চারজন বিজিবি সদস্য ও স্থানীয় দু’জন সংবাদকর্মী সামনে গিয়ে দেখতে পান ভয়ে কাঁপছে কয়েকজন নারী ও শিশু। এরইমধ্যে আরো সাতটি নৌকা এসে হাজির হয়। নৌকাগুলোতে অন্তত: ৫০ জন রোহিঙ্গা। এভাবে রাত ১১টা পর্যন্ত ৪৭টি নৌকায় রোহিঙ্গারা আসেন। পরে তাদের বেড়িবাঁধে জড়ো করা হয়।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসা নৌকাগুলোর একটি মাঝি রহমত উল্লাহর সাথে কথা হয়। তিনিও রোহিঙ্গা।

তিনি জানান, ‘প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের নৌকায় করে নাফনদী পার করছি। মিয়ানমার পুলিশ (বিজিপি) আমাকে কিছু বলে না। কারণ প্রতি ট্রিপে তাদেরকে ৫০ হাজার কায়াট দেই। ওপার থেকে এপারে আসতে এক ঘণ্টা সময় লাগে। মংডু থেকে বুচিডংয়ের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। সেখানে ৩২০টির মতো গ্রাম আছে। এসব গ্রামে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাস। আগস্টের শেষের দিক থেকে রোহিঙ্গাদের চলে আসা শুরু হলেও যারা সেখানে টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন তাদেরও এখন চলে আসতে হচ্ছে। কেননা গত এক মাস ধরে সেখানকার লোকজনকে চলাফেরা করতে দিচ্ছে না সেনারা। ফলে সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।

তারা কেন বাংলাদেশে চলে আসছেন প্রশ্ন করা হলে কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, তাদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করছে মিয়ানমার প্রশাসন। সেনা ও উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা এখনো আরাকানে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে আতংক সৃষ্টি করেছে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাচিডং-এর নাইংচং রোহিঙ্গা গ্রামে অবশিষ্ট ঘরবাড়িগুলো সেনাবাহিনী ও উগ্র রাখাইনরা জ্বালিয়ে দিয়েছে।

তারা আরো জানান, বুচিডং উপজেলার নারাইংশং, রোইঙ্গাদং, চিন্দং, ওলাফে, কুইন্দাং মগনা পাড়া রাজাবিড়া, দাব্রিঅং, চাংগ্রি পাড়াসহ বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা পল্লীতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীদের শ্লীলতাহানী করেছে সেনারা। অক্ষত ঘরবাড়িগুলো প্রতিদিনই পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বাঁচতে চাইলে তাদেরকে বাংলাদেশে চলে যাবার ঘোষণা দিয়ে মাইকিং করছে প্রশাসন।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারারা জানিয়েছেন, এখনো প্রতিটি গ্রাম মহল্লায় তল্লাশি অব্যাহত রয়েছে। যারা নিজের ভিটে বাড়ির টানে এখনো আরকানের জঙ্গলে লুকিয়েছিলেন, খাদ্য সংকটে পড়ে তারাও পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসছেন। পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছে যে রোহিঙ্গারা দিনে ও রাতে ঝুঁকি নিয়ে ছোট নৌকায় করে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসছেন। এতে দুর্ঘটনার আশংকা দেখা দিয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার ও আগের দিন বুধবার পালিয়ে বাংলাদেশে আসার জন্য হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষ নাফ নদী ও সাগর উপকূলে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নৌকার ভাড়া না থাকায় তারা অনেকেই পালিয়ে আসতে পারছেন না। ওপারে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার অপেক্ষায় রয়েছেন। অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে ছোট নৌকায় নদী ও সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ আসছেন।

শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা মাস্টার জাহেদ হোসেন বলেন, রাতের আঁধারে ছোট ছোট নৌকায় করে মংডু শহরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুরা পালিয়ে আসছেন।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, নাফ নদী পার হয়ে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা বৃদ্ধা হালিমা খাতুন বলেন, ‘আমার বাড়ি মিয়ানমারের শীলখালী গ্রামে। রাখাইনে সহিংসতার পরও কোনো রকম না খেয়ে পালিয়েছিলাম। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহ আগে স্বামী বদিউল আলম নিখোঁজ হয়ে যায়। কিন্তু গত রোববার রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও মগরা এসে মাইকিং করে চলে আসার নির্দেশনা দেয়। এ কারণে অন্যদের সাথে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি।’

গতকাল বুধবার সকালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বলিবাজার গ্রাম থেকে এসেছেন কবির আহমদ ও ছমুদা খাতুন। এ দম্পতি জানিয়েছেন আরকানে থাকা আর সম্ভব নয়। সেনা ও উগ্র মগদের অব্যাহত সহিংসতার পরও তারা বাংলাদেশে আসেননি। কিন্তু, নতুন হুমকির কারণে আর থাকতে না পেরে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

তারা বলেন, ‘প্রতিদিন সেনাবাহিনী ও মগরা বিভিন্ন গ্রামে তল্লাশি করে এবং খালি পড়ে থাকা বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে।’

টেকনাফ উপজেলার উলুবনিয়া সীমান্তে বসবাসকারী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হারুনর রশিদ জানান, বুধবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রাখাইনের কুমিরখালী ও শীলখালী এলাকায় একের পর এক গ্রাম জ্বলতে দেখেছেন তিনি। এ দৃশ্য স্থানীয়দের পাশাপাশি বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও দেখেছে। এ কারণে আরাকানে এতদিন লুকিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে ছুটে আসছেন।

মংডুর খইল্যাভাঙ্গা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নবী হোসেন, আজিজুল রহমান ও আহমদ আলী বলেন, ‘জীবন বাঁচাতে এখানে পালিয়ে এসেছি। সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামে কোনো রোহিঙ্গাদের থাকতে দিচ্ছে না। ভালো কাঠের তৈরি ঘরগুলো তারা দখল করছে। দিনের বেলায় প্যারাবনের পাশে নৌকার মাঝিদের ঘরে থাকতে হচ্ছে। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ধান ক্ষেতে লুকিয়ে থাকেন। রাতের আঁধারে নৌকায় নাফ নদী পাড়ি দিতে হচ্ছে। নৌকা ডুবির হলে অনেক লোক মারা যাবে।’

তারা আরো বলেন ‘সেনা সদস্যরা মুসলমানদের ঘরবাড়ি দখল করছে। জীবন বাঁচাতে পেরে অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন। এসব ব্যবসায়ীর গরু, শুটকি, আচারসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। বাড়ি রক্ষা করতে আগামী ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে ১৩ কোটি কিয়াট দিতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। এরপর কি হবে জানি না। বাংলাদেশ থেকে বড় বড় ফিশিং ট্রলার যাচ্ছে না। এদিকে মিয়ানমারে জীবন-যাপন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। তাই নিরুপায় হয়ে ঝুঁকি সত্বেও ছোট নৌকায় করে বাংলাদেশে চলে এসেছি।’

সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন ‘সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোররাত পর্যন্ত নাফনদী পার হয়ে প্রায় সাড়ে চার হাজারের মতো রোহিঙ্গা এসেছে।

টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গারা ছোট ছোট দলে নৌকায় করে রাতের আঁধারে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে।

এদিকে ২০টি দেশের কূটনীতিকদের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আরাকানের অংশবিশেষ ঘুরে দেখানো হয়েছে। সেখানে মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্ম্বালম্বী মানুষের সাথে কথা বলেন তারা। তবে রোহিঙ্গাদের উপর সেনা তাণ্ডবের কথা কূটনীতিকদের সামনে না বলার জন্য আগে থেকে সতর্ক করে দেয়া হয়। কেউ মুখ খুললে তাকে প্রাণনাশের হুমকিও দেয় প্রশাসন। সুত্র: নয়া দিগন্ত

পাঠকের মতামত