প্রকাশিত: ২৮/০৬/২০১৮ ৭:৫৩ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১:২৭ এএম
ফাইল ছবি

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের অন্তত ১০টি উগ্র ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্রায় ২৩টি ইয়াবা কারখানা। এসব কারখানায় ১৩ ধরনের ইয়াবা তৈরি হয়। বাংলাদেশ ওইসব কারখানার নাম, ঠিকানা এবং প্রস্তুতকারী সংগঠনের নাম মিয়ানমারকে সরবরাহ করলেও কারখানাগুলো বন্ধ করেনি সে দেশের সরকার। বরং প্রতিবছর ইয়াবা ব্যবসার বিস্তার বাড়িয়েছে মিয়ানমার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ইয়াবা তৈরি, সরবরাহ এবং এর বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধে মিয়ানমার কথা রাখেনি।

যেসব এলাকায় ১০ সংগঠনের ইয়াবা কারখানা

মিয়ানমারের কুখাই এলাকায় কাচিন ডিফেন্স আর্মি, নামখাম এলাকার পানহাসাই কিয়াও মিয়াও ইয়াং মৌলিয়ান গ্রুপ, কিউলং এলাকার হ স্পেশাল পুলিশ এক্স হোলি ট্রাক্ট গ্রুপ, ট্যাংগিয়ান এলাকার এক নম্বর ব্রিজের কাছে ম্যানপ্যানং মিলিটিয়া, মংহা মিলিটিয়া, শাহ এস্টেট আর্মি (উত্তর), মংসু এলাকার ইয়ানজু গ্রুপ ও লই হসপুসুর, নামজাং এলাকার শাহ ন্যাশনালিটিজ পিপল লিবারেশন (এসএনপিএল) এবং কাই-শাহ চৌ সাং (নাইয়াই) গ্রুপ, কাক্যাং মংটন এলাকার ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউএসএ-ইউসা), মংশিট এলাকার লাহু মিলিটিয়া, টাকিলেট এলাকার লাহু মিলিটিয়া, মংপিয়াং এলাকার লাহু মিলিটিয়া, মংইয়াং এলাকার লাহু মিলিটিয়া, পাংশাং এলাকার লাহু মিলিটিংয়া, মাওকিমাই এলাকার শাহ ন্যাশনালিটিজ পিপল আর্মি এবং মিয়ানমারের কোকান এলাকার মিয়ানমার ন্যাশনাল ডিমোক্রাটিক অ্যালিয়েন্স আর্মি ইয়াবা কারখানা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

উগ্র ও বিচ্ছিন্নতাবাদী এসব সংগঠনগুলো সীমান্ত এলাকায় ইয়াবা তৈরির কারখানা স্থাপন করে। পাহাড়ের গুহায় ও পাদদেশে ইয়াবা কারখানাগুলোর বিষয়ে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অবগত। অভিযোগ রয়েছে, দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় এসব কারখানা পরিচালিত হয়। তারা এই মাদক ব্যবসা থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে থাকে।

তৈরিহয়১৩ধরনেরইয়াবা

উগ্রবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এসব কারখানায় যে ১৩ ধরনের ইয়াবা তৈরি হয়, সেগুলো হলো— ডব্লিউওয়াই (WY), ৮৮৮ আর-২ (888R2), ওকে (OK), গোল্ড (Gold), টাইগার (Tiger), হার্ট (Heart), চিকেন ওয়ার্ল্ড (Chiken), এসকুল (SKull), হই (Hoe), হর্স শো (Horse Shoe), হর্স হেড (Horse Head) এবং ফ্লাওয়ার (Flower) ইত্যাদি। বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসা ও বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে জব্দ ইয়াবার মধ্যে এ সব নাম পাওয়া গেছে।

নাফ নদী পার হলেই কয়েক গুণ দাম বাড়ে ইয়াবার

মাদক ব্যবসায়ীরা এসব ইয়াবা বিভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। মিয়ানমারে প্রতিটি ইয়াবার দাম বাংলাদেশি ১৬ টাকা। নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকামাত্র জ্যামিতিক হারে দাম বেড়ে যায়। ওপারের ১৬ টাকার ইয়াবা এপারে বিক্রি হয় ৯০ টাকায়। এরপর চট্টগ্রাম হয়ে যখন সেগুলো দেশের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তখন একেকটি ইয়াবার ‍খুচরা মূল্য দাঁড়ায় গিয়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।

বিজিবি টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আছাদুদ জামান চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইয়াবা আসক্তি আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংস করে দেবে। আমরা সীমান্ত এলাকায় অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে কাজ করছি। মাদক ব্যবসায়ীরা মিয়ানমার সীমান্ত থেকে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা নিয়ে আসে। আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। এখন ইয়াবা পাচার প্রায় বন্ধ রয়েছে।’

মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এসব কারখানার তালিকা এবছরের শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওই দেশটিকে দেওয়া হয়েছে। তবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের— তালিকায় থাকা ওইসব এলাকায় তারা কোনও ইয়াবা কারখানা পায়নি। মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) আরও নির্দিষ্ট করে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) কাছে ঠিকানা চেয়েছে। তবে মিয়ানমার সব সময় ইয়াবার বিষয়টিতে অসহযোগিতা করে আসছে বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশে প্রতিদিন ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের হিসাবে অন্তত ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ ইয়াবা সেবন করে। বর্তমানে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মাদকসেবীদের কাছে নেশার দ্রব্য হিসেবে পছন্দ হচ্ছে ইয়াবা। চাহিদা বাড়ায় দেশে ইয়াবা তৈরির আগ্রহ বাড়ছে মাদক ব্যবসায়ীদের।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে, ২০১৭ সালে মাদক উদ্ধার ও পাচার সংক্রান্ত বিষয়ে এক লাখ মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ৩৫ হাজার মামলাই ইয়াবার। বাকি মামলাগুলো অন্যান্য মাদক সংক্রান্ত। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে ইয়াবার ভয়াবহতা।

সোমবার (২৫ জুন) সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘ইয়াবা ব্যবসা বন্ধের বিষয়ে মিয়ানমার প্রতিশ্রুতি দিয়েও রক্ষা করেনি। ইয়াবা ট্যাবলেট তৈরি, সরবরাহ ও এর ব্যবসা বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশকে দেওয়া কথা রাখেনি মিয়ানমার।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ইয়াবা বানায় মিয়ানমার। বাংলাদেশ বা ভারত কোথাও ইয়াবা তৈরি হয় না। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত শুধু টেকনাফ বা নাফ নদীই নয়। এর বাইরেও অনেক সীমান্ত দিয়ে নানাভাবে পাচার হয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশ করছে। মিয়ানমারের ইয়াবা সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়েও বাংলাদেশে আসছে, সমুদ্রসীমা দিয়েও আসছে।’ তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সীমান্তে ইয়াবার কারখানা রয়েছে। এই ইয়াবা পাচার বন্ধে আমি নিজে সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেদেশের প্রেসিডেন্টসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক চুক্তিও করেছি। কিন্তু কোনও কথাই রাখেনি মিয়ানমার। তারা মুখে বলছে কাজ করবে। কিন্তু কোনও কাজই করেনি। ভারত কিন্তু বাংলাদেশের আবেদনে সাড়া দিয়ে অনেক সীমান্তে ফেনসিডিলের কারখানা বন্ধ করেছে। এগুলো তো দৃষ্টান্ত।’

পাঠকের মতামত