প্রকাশিত: ৩০/০৭/২০১৭ ৭:৪৩ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৩:৫৯ পিএম
ফাইল ছবি

নিউজ ডেস্ক::
মানবপাচার ঠেকাতে আগে বিভিন্ন সময়ে পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদেরই সামনে তুলে এনেছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি। কক্সবাজারে ওই ব্যক্তিরা এখন নিজেদের পাচারের ঘটনা তুলে ধরে মানবপাচার প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখছেন। দুই বছর আগে বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বিপুলসংখ্যক অবৈধ অভিবাসন ও মানবপাচারের ঘটনায় চাপে পড়েছিল সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং সার্বিকভাবে মানবপাচার মোকাবেলায় সরকার অনেক উদ্যোগ নিলেও তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। গত জুন মাসে দেশটি বৈশ্বিক মানবপাচার পরিস্থিতি নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বাংলাদেশকে নজরদারির তালিকায় রেখেছে।

যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, বাংলাদেশে মানবপাচারসংক্রান্ত অপরাধের তদন্ত ও বিচারে জটিলতাই বড় সমস্যা। মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ব্যাপারে তদন্ত ও বিচার হয়নি।

এর আগে টানা পাঁচ বছর মানবপাচার প্রতিরোধবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ‘টায়ার-২’-এ থাকলেও এ বছর প্রকাশিত প্রতিবেদনে এর চেয়ে এক ধাপ নিচে ‘টায়ার-২ ওয়াচ লিস্ট’-এ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে মানবপাচার মোকাবেলায় বাংলাদেশ কী ভূমিকা রাখছে সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরো নিবিড় দৃষ্টি থাকছে।

‘টায়ার-২’ তালিকায় থাকার অর্থ কোনো দেশ পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ন্যূনতম সুরক্ষা দেওয়ার আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করতে পারলেও এ ব্যাপারে চেষ্টায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। ‘টায়ার-২ ওয়াচ লিস্টে’ থাকা দেশগুলোও পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ন্যূনতম সুরক্ষা দেওয়ার আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি এবং এ দেশগুলোতে পাচারের শিকার ব্যক্তির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। এ ছাড়া সরকার আগের বছরের তুলনায় পাচার মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য চেষ্টা চালাতে পারেনি। তবে পাচার মোকাবেলায় আগামী বছরগুলোতে আরো উদ্যোগ নেওয়ার অঙ্গীকার রয়েছে।

মানবপাচার ও বিপজ্জনক অভিবাসনের প্রভাব শুধু পাচার হওয়া ব্যক্তিই নয়, তাঁর পুরো পরিবার বিশেষ করে সন্তানদের ওপরও পড়ে। বিশ্ব মানবপাচার প্রতিরোধ দিবসের প্রাক্কালে জাতিসংঘের দুজন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে বলেছেন, অভিবাসী সন্তানরা পাচার ও নিপীড়নের ঝুঁকিতে আছে। তাদের সুরক্ষায় বিদ্যমান ব্যবস্থা কোনো কাজে আসছে না। জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার মারিয়া গ্রাজিয়া গিয়াম্মারিনারো এবং মওদ ডি বুয়ের-বুকিছিও বলেন, সংঘাত বা মানবিক সংকটের সময় শিশুদের সুরক্ষার ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিপজ্জনক পথে যাত্রা এবং সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোতে অনেক শিশু মারা গেছে।

‘চলুন, পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও সহযোগিতায় এখনই কাজ করি’—এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ ৩০ জুলাই এ বছরের বিশ্ব মানবপাচার প্রতিরোধ দিবস পালন করতে যাচ্ছে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দপ্তর (ইউএনওডিসি)। এ উপলক্ষে এক বিবৃতিতে ইউএনওডিসির নির্বাহী পরিচালক ইউরি ফেদতভ বলেন, সংঘাতের সঙ্গে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পাচার হওয়ার যোগসূত্র থাকার কারণে এ প্রতিপাদ্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সংঘাত এড়াতে অন্যত্র ছুটে যাওয়া ব্যক্তিরা পাচারকারী চক্রের হাতে গিয়ে পড়ছে।

তদন্ত ও বিচারে জটিলতা : ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডে মানবপাচারের শিকার হওয়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের গণকবর চিহ্নিত এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জিম্মি উদ্ধার হওয়ার পর থাই কর্তৃপক্ষ দেশটির এক সাবেক জেনারেলসহ বেশ কয়েকজন হোতার বিচার করেছে। তবে বাংলাদেশে মানবপাচারকারীরা এখনো বিচারের মুখোমুখি হয়নি।

গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবপাচারসংক্রান্ত অপরাধগুলোর তদন্ত ও বিচারে জটিলতাই বড় সমস্যা। মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ব্যাপারে তদন্ত ও বিচার হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, মানবপাচার ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নিলেও তাতে ন্যূনতম মান রক্ষা হয়নি। বিশেষ করে, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে সরকারের প্রয়াস বিশেষ মাত্রায় বাড়েনি।

বিদেশে কর্মী নিয়োগ ফি কমাতে সরকার বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এর পরও সরকার বিদেশে কর্মী নিয়োগের জন্য বড় অঙ্কের ফি নেওয়ার এবং সাব-এজেন্টদের মাধ্যমে অবৈধভাবে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দিয়ে তাদের পাচারের ঝুঁকিতে ফেলছে বলে যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখ করেছে।

পাচারের অন্যতম উৎস এখনো বাংলাদেশ : মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের গত জুন মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশ বিদেশে শ্রমদাসত্ব ও যৌনতার জন্য পাচারের অন্যতম প্রাথমিক উৎস হয়ে আছে। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও পূর্ব আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছায় কাজ করতে যাওয়া অনেক নারী-পুরুষকে জোর করে খাটানো হয়। অনেকেই দেশ ছাড়ার আগে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে অনেক বেশি অর্থ দিয়ে দালালের মাধ্যমে বিদেশে পাড়ি জমায়। অনেক রিক্রুটিং এজেন্সিও অভিবাসী কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করে। ফলে ভালো চাকরি ও বেতনের কথা শুনে বিদেশে গিয়ে তারা বিপরীত চিত্র দেখতে পায়।

ওই প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে অবস্থানরত মিয়ানমারের রোহিঙ্গারাও পাচারের ঝুঁকিতে আছে। মিয়ানমারে নাজুক পরিস্থিতির ফলে এবং অপেক্ষাকৃত ভালো পরিবেশ পাওয়ার আশায় আগে রোহিঙ্গারা বিশেষ করে সাগরপথে বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে মানবপাচারকারীচক্রের হাতে পড়েছে—এমন অনেক উদাহরণ আছে।

ইউএনওডিসির গত বছরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ৮৫ শতাংশই বেশি ওই অঞ্চলের বাসিন্দা। এর মধ্যে ছয় শতাংশের উৎস দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারত। বাকি পাঁচ শতাংশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়।

মধ্যপ্রাচ্যে পাচারের শিকার হওয়া দক্ষিণ এশীয়রা মূলত বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তানের নাগরিক। পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তাদের হার প্রায় ৯ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ থেকে সাগরপথে অবৈধভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যাওয়ার প্রবণতা কমেছে। সাগরপথে অবৈধভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে যাওয়ার সময় মানবপাচারকারীদের হাতে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে কিছু বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা। তাদের জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে। আর তারা বা তাদের স্বজনরা তা দিতে না পারলে শ্রমদাস হিসেবে তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয়।

এ ছাড়া গৃহকর্মী হিসেবে বৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো নারীকর্মীদের বড় অংশই নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। লেবানন ও জর্ডানে যাওয়া গৃহকর্মীদের কয়েকজনকে বিক্রি করে সিরিয়ায় পাঠানো হয়েছে। তারা যৌনতা ও শ্রম দেওয়ার জন্য পাচারের শিকার হয়। এর বাইরে বাংলাদেশি নারী ও শিশুদের ভারত ও পাকিস্তানে পাচার হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ঝুঁকছে দালাল ও পাচারকারীচক্রের দিকে : কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, বিদেশে শ্রমবাজার ক্রমেই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজারগুলোরও একটি নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা আছে এবং বাংলাদেশ তা প্রায় পূর্ণ করে ফেলেছে। এখন চাহিদা আছে দক্ষ কর্মীদের।

বিগত বছরগুলোতে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অভিবাসনপ্রত্যাশীরা অসাধু কিছু ট্রাভেল এজেন্সির প্রলোভনে পড়ে মানব পাচারকারীচক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। পাচারকারীচক্র বিভিন্ন দেশ ঘুরিয়ে স্থলপথে তাদের লিবিয়ায় নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ দাবি করেছে।

এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অস্থির পরিস্থিতিতে অনেক বাংলাদেশি কর্মী দেশে ফিরে না এসে ইউরোপে যাওয়ার জন্য দালাল ও মানব পাচারকারীচক্রের দিকে ঝুঁকেছে।

বাংলাদেশের জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ যুক্তরাষ্ট্রের : অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মীদের কাছ থেকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সব ধরনের ফি আদায় বন্ধ করতে বাংলাদেশকে সুপারিশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া অভিবাসী কর্মীদের বেতনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, মানবপাচারকারী ও প্রতারক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত ও বিচার করতেও যুক্তরাষ্ট্র সুপারিশ করেছে।

বিদেশে বাংলাদেশি কর্মীদের সুরক্ষা দিতে দূতাবাসগুলোকে উদ্যোগ নিতে এবং মানবপাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
কালেরকন্ঠ

পাঠকের মতামত

‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার রাজি থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ার কারণ খুঁজতে হবে’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ...