উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৪/০৫/২০২৩ ৮:০৯ এএম

ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে ১২ মে রাত থেকে বন্ধ রয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ। ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সাগরে ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এলএনজি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমেছে। লোডশেডিং হচ্ছে ঘন ঘন। গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ নেই শিল্প-কারখানায়। আবাসিকে গ্যাসের সংকট তীব্র। সিএনজি স্টেশনগুলোয়ও ছিল গ্যাস নিতে আসা যানবাহনের ভিড়।

পরিস্থিতি বিবেচনা করে টার্মিনাল দুটি পুনঃস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও গতকাল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে মহেশখালীর দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই বেশ কয়েকটি গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন আংশিক চালু বা বন্ধ থাকছে। ফলে ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। অনাকাঙ্ক্ষিত এ অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কেটে যাওয়া মাত্রই ভাসমান টার্মিনালগুলো পুনরায় স্থাপন করে গ্যাস সরবরাহ এবং গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালু করা হবে।’

দুর্যোগে বিদ্যমান টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৮ সালে সাগরে এলএনজি টার্মিনালের পাইপলাইনে ছিদ্র দেখা দিলে দুর্যোগে সাগর উত্তাল থাকায় তা মেরামত করতে অনেক সময় লেগে যায়। সামনের দিনগুলোয়ও এ ধরনের দুর্যোগের মাত্রা আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরাও আশঙ্কা করছেন, দুর্যোগের মাত্রা বাড়লে ভবিষ্যতেও এলএনজি সরবরাহে ব্যাঘাতের পাশাপাশি সরবরাহ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা বারবার ঘটতে পারে।

এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে ঘূর্ণিঝড়-সাইক্লোনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের হটস্পট হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল। আমদানীকৃত এলএনজির সরবরাহ ঠিক রাখতে হলে এজন্য নির্মিত অবকাঠামোগুলো টেকসই ও মজবুত হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া এলএনজি মজুদের সক্ষমতা বাড়ানোও বিশেষভাবে জরুরি। এর সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগুলো নির্মাণের আগেও যথাযথভাবে পরিবেশগত সমীক্ষা চালানো প্রয়োজন। অন্যথায় দুর্যোগের কারণে দেশের গোটা গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থায়ই মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অন্য কোনো কারণে এলএনজি টার্মিনালের সরবরাহ সংকট এড়াতে মজুদ সক্ষমতা গড়ে তোলা দরকার, যাতে সংকটকালীন মুহূর্তে মজুদ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়। উন্নত বিশ্ব বিশেষত ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গ্যাসের বৃহৎ মজুদ সক্ষমতা রয়েছে। তারা সংকটকালে মজুদ দিয়েই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে আমাদের মজুদ সক্ষমতা রয়েছে। এখন কয়লা ও গ্যাসের মজুদ সক্ষমতা দরকার। তবে এ ধরনের অবকাঠামোয় প্রচুর বিনিয়োগও প্রয়োজন। সামনে আমাদের আরো ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ-সংক্রান্ত পরিকল্পনা নিতে হলে তা অনেকগুলো বিষয় মাথায় রেখেই নিতে হবে।’

দেশে বর্তমানে দুটি এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। দুটি টার্মিনালের দৈনিক সরবরাহ সক্ষমতা ১০০ কোটি ঘনফুট। দুটি টার্মিনালই কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবস্থিত। এর একটির মালিকানায় রয়েছে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি। অন্যটি আছে জ্বালানি খাতের স্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের মালিকানায়। আগামী ২০৩২ ও ২০৩৩ সাল পর্যন্ত সরবরাহের পর টার্মিনাল দুটি পেট্রোবাংলার মালিকানায় স্থানান্তরের কথা রয়েছে। এছাড়া দেশে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে আরো ১০০ কোটি ঘনফুট সক্ষমতার দুটি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে জ্বালানি বিভাগের। দুটি টার্মিনালই নির্মাণ করা হবে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায়।

দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত বৃহৎ পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে সাগরতীরের মাতারবাড়ী ও পায়রাকে কেন্দ্র করে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের তীব্র ঝুঁকিযুক্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এ ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এ কারণে সামনের দিনগুলোয় উপকূলে বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ করতে হলে তা দুর্যোগজনিত ঝুঁকিগুলোকে ভালোভাবে বিবেচনায় নিয়েই করতে হবে বলে অভিমত দিয়েছেন পরিবেশবিদরা।

দেশের জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল দুটির গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু সেখান থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে থাকায় এরই মধ্যে বেশকিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আবাসিক, শিল্প-কারখানা ও সিএনজি স্টেশন তীব্র গ্যাস সংকটে পড়েছে।

বিশেষ করে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বিপাকে পড়েছে সবচেয়ে বেশি। গ্যাসের সরবরাহ কমায় উৎপাদন কমেছে কেন্দ্রগুলোর। সারা দেশে বেড়েছে লোডশেডিং। রাজধানীতেও গতকাল ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে তীব্র ভোগান্তিতে পড়েছে বিদ্যুতের গ্রাহকরা।

বিতরণকারী সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (টিজিটিডিসিএল) পক্ষ থেকেও এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে এলএনজি সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় তিতাস অধিভুক্ত এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করছে। এলএনজি সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত গ্যাসের স্বল্প চাপ থাকবে। ফলে তিতাসের আওতাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় গ্যাসের সংকট থাকায় উৎপাদনে এর প্রভাব পড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের মতো। গ্যাস স্বল্পতার কারণে গ্যাসভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রই এখন বন্ধ। এতে গ্যাসভিত্তিক উৎপাদন কমেছে দুই হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রয়েছে। মেঘনাঘাট, হরিপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রও গ্যাস স্বল্পতার কারণে বন্ধ রয়েছে।’

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ঘণ্টাপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও লোডশেডিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল গোটা দিনব্যাপী বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনে ঘাটতি ওঠানামা করেছে দুই হাজার মেগাওয়াটের আশপাশে। বিশেষত গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বেশি হচ্ছে বলে পিজিসিবির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে। এফএসআরইউ থেকে এলএনজি সরবরাহ বন্ধের আগে ১২ মে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ছিল ৬ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। সেখানে রাত ৯টায় সান্ধ্য পিক আওয়ারে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ছিল ৪ হাজার ৬৬৭ মেগাওয়াট।

রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলের বাসাবাড়িতে গতকাল দুপুরের পর থেকে গ্যাসের চুলা নিবু নিবু করেছে সন্ধ্যা পর্যন্ত। ব্যবসায়ীরাও জানিয়েছেন, শিল্প-কারখানায় গ্যাসের চাপ ছিল খুবই কম। এছাড়া সিএনজি স্টেশনগুলোয় গ্যাস নেয়ার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন।

লোডশেডিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে বিতরণ সংস্থা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডিপিডিসি এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য লোডশেড করতে হচ্ছে। ডিপিডিসি এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে ৪৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত।’

পাঠকের মতামত