
আব্দুর রহমান, টেকনাফ (কক্সবাজার)
সরওয়ার কামাল সরকারি চাকুরে। কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সচিব। আইনে বলা আছে, সরকারি চাকরিকালে কোনো কর্মচারী লাভজনক ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবেন না। চাকরির এই আইনটি সরওয়ার কামালেরও জানা। তারপরও তিনি ভেঙেছেন বিধি। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট হয়ে করছেন ধুন্ধুমার ব্যবসা। এমনকি গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎসহ ভিজিডি কার্ড বাণিজ্যের অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এখন ফ্ল্যাট, গাড়ি, মাছের খামার সবই আছে তাঁর। আছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ। নামে-বেনামে সম্পদ। সরকারি চাকরির স্বল্প বেতনে এত সম্পদ গড়ার সুযোগ নেই। মূলত হুন্ডি, রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন, ঘুষ বাণিজ্য, ভিজিডি কার্ডের অনিয়মসহ বিভিন্ন উপায়ে বিপুল সম্পদের মালিক বনেছেন তিনি।
২০১৫ সালের জুনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সোনা আলীর হাত ধরে সচিব পদে যোগ দেন সরওয়ার কামাল। প্রায় ১০ বছর চাকরি করে সরকারের কাছ থেকে সর্বসাকল্যে বেতন পেয়েছেন ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা। তাঁর জন্ম টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়া গ্রামে, বাবা প্রয়াত নুর মোহাম্মদ ছিলেন পেশায় জেলে। ভিটেবাড়ি ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না পরিবারের। তবে এখন হিসাব কষলে তাঁর অর্জিত সম্পদ ছয় কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আয়ুব অভিযোগ করেন, সচিব সরওয়ার কামালসহ আমরা কয়েকজন অংশীদার ব্যবসায়ী ছিলাম। তখন তাঁর পরিচালিত এজেন্ট ব্যাংকে ভিজিডি চালের টাকা সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের হিসাবে জমা না দিয়ে সচিব ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গ্রাহকরা চাপ দিলে কিছু টাকা ফেরত দেন। এখনও অনেকে টাকা পাবে, আমরাও পাব। বিষয়টি খতিয়ে দেখে জেলা প্রশাসনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
কত সম্পদ
কক্সবাজারের তারাবনিয়ার হাসিমিয়া মাদ্রাসার প্রধান রাস্তায় দেড় কোটি টাকা দামের তাঁর একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া শাহপরীর দ্বীপ মৌজার ২৩০৮ খতিয়ানে ছয় শতক, একই মৌজার ২৫-৭৪৪৭ খতিয়ানে ৯ দশমিক ৩০ শতক, ২৬১৬ খতিয়ানে ৯ দশমিক ৫০ শতক, ২৫-৭৪১০ খতিয়ানে ৮০ শতকের জমিতে একটি বিশাল খামার আছে। যেটি নাফ ইন্টারন্যাশনাল ব্যান্ড প্রতিষ্ঠানের নামে থাকলেও সেটির বেশির ভাগ অংশই সরওয়ার কামালের। এসব জমির আশপাশে নামে-বেনামে সচিবের আরও সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া দুটি পালকি বাস ও একটি প্রাইভেটকারও আছে তাঁর। পাশাপাশি ছয়টি ব্যাংকে রয়েছে একাধিক হিসাব। সেখানে কত টাকা গচ্ছিত আছে তা জানতে পারেনি সমকাল।
খামারে অফিস
শাহপরীর দ্বীপের বাজার পাড়ায় সরেজমিন গিয়ে মাছের দুটি পুকুর, গরু ও মুরগির খামার দেখা যায়। এ সময় খামারে দুজন রোহিঙ্গা শ্রমিক কাজ করছিলেন। খামারে একটি ভবনে দুটি কক্ষ আছে, এর একটি সচিবের অফিস ঘর। ভেতরে ল্যাপটপ, ফাইল ও ইউনিয়ন পরিষদের সরকারি কাগজপত্র ছড়ানো-ছিটানো। অন্য কক্ষে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নথিপত্রের স্তূপ।
স্থানীয় এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সচিব খামারে বেশি সময় অফিস করেন। বলতে গেলে খামারে আলাদা ‘ইউনিয়ন পরিষদ’ খুলে রেখেছেন। সেখানে অবৈধ সব কার্যক্রম চালান।
সচিবের এজেন্ট ব্যাংকিং
সরওয়ার কামালের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘মেসার্স নূর এন্টারপ্রাইজ’ ২০১৯ সালে শাহপরীর দ্বীপে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট শাখার অনুমতি পায়। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ধারা ১৫ এবং সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারী ব্যবসা বা এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারেন না। ফলে এটি স্পষ্ট আইন লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ব্যাংকের কর্মচারী ও গ্রাহকের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, এই এজেন্ট ব্যাংকের দায়িত্বে থাকার সুযোগে সাবরাং ইউনিয়নের ভিজিডি কার্ডের সুবিধাভোগীদের পাঁচ হাজার ৩০০ জন সেখানে হিসাব খুলেছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিজনের হিসাবে মাসে ২২০ টাকা করে জমা হওয়ার কথা থাকলেও সেই টাকা জমা না দিয়ে গ্রাহকের দুই কোটি টাকার বেশি নিজের কাজে ব্যবহার করেছিলেন সচিব, যা ছিল নিয়মবহির্ভূত।
জানতে চাইলে টেকনাফের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বিক্রয় ব্যবস্থাপক যায়েদ ইকবাল বলেন, ‘সরওয়ার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট শাখা নিয়েছিল– সেটি আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে। এ কারণে সচিবকে কীভাবে এজেন্ট ব্যাংকের শাখা দেওয়া হয়েছে, তা আমি জানি না। তবে এটা সত্য, সেই শাখার কিছু গ্রাহক টাকা পাচ্ছে না, সেই টাকা সচিবের পরিশোধ করার কথা রয়েছে।
এজেন্ট শাখায় তালা
শাহপরীর দ্বীপে রাস্তার মাথায় আমির হোসাইন মার্কেটের ওপরে ছিল ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট শাখাটি। এখন সেখানে তালা ঝুলছে। ব্যাংকে কাউকে না পেয়ে প্রতিদিন ফেরত যাচ্ছেন গ্রাহক।
ব্যাংকের গ্রাহক শাহপরীর দ্বীপের মিস্ত্রিপাড়ার বাসিন্দা নুর কায়েছ। স্বামী প্রবাসী মোহাম্মদ ইসমাইলের নামে সেখানে একটি সঞ্চয় হিসাব (নম্বর: ৭০১৭৩৪২৬৫৩৫০১) খুলেছিলেন। সেখানে চার কিস্তিতে ২২ হাজার টাকা জমা দেওয়ার রসিদ রয়েছে। নুর কায়েছের মতো ফরিদা ইয়াছমিন, মো. হারিছ, রিনা আক্তার, হালিমা বেগমসহ আরও শত শত গ্রাহক রয়েছেন। যারা ব্যাংক বন্ধের কারণে লেনদেনসহ টাকার হিসাব পাচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে শাহপরীর দ্বীপের নুর কায়েছ বলেন, চার কিস্তিতে ২২ হাজার টাকা জমা দিয়েছি। তবে ব্যাংক তালাবদ্ধ থাকায় জমা টাকা তুলতে পারছি না। কষ্টের জমানো টাকা ফেরত পাব কিনা দুশ্চিন্তায় আছি। তাছাড়া ভিজিডি কার্ডের জমা দেওয়া কিছু টাকা পায়নি এখনও।
জানতে চাইলে ব্যাংকের সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সালাম বলেন, পাঁচ হাজারের বেশি নারী গ্রাহকের হিসাব ছিল আমাদের শাখায়। কিন্তু গ্রাহকদের টাকা হিসাবে জমা না দিয়ে সচিব নিজের কাজে ব্যবহার করে আসছিলেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। তিনি বলেন, পরে কিছু টাকা ফেরত দিলেও এখনও শত শত গ্রাহক টাকা পাবে। আমিও অংশীদার হিসেবে সচিবের কাছ থেকে অনেক টাকা পাই।
কারা কী বলছেন
অভিযোগের ব্যাপারে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সচিব সরওয়ার কামাল বলেন, ‘আমার পরিচালনায় একটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট শাখা ছিল, এখন সেটি নেই। তবে এটা সত্য, আমার অংশীজন কিছু টাকা পাবে।’
তিনি বলেন, ‘যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কক্সবাজারে ফ্ল্যাটসহ কোথাও আমার সম্পদ নেই; বরং এখন আমি প্রায় দেউলিয়া। তবে স্বীকার করছি, সরকারি কর্মচারী হয়ে এজেন্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত হওয়াটা আমার বড় ভুল ছিল।’
এ বিষয়ে টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, সরকারি কর্মচারী হয়ে কখনও লাভজনক ব্যবসা করার সুযোগ নেই। সেটি করে থাকলে চাকরিবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টাকা আত্মসাৎসহ সম্পদ অর্জনের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান বলেন, সরকারি কর্মচারী হয়ে এ ধরনের কাজে জড়িত থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুত্র,সমকাল

পাঠকের মতামত